Wednesday, July 17, 2013

এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইট ৪৫৯০: অন্তিম যাত্রায় আকাশের রানী কনকর্ড-প্রথম পর্ব























২৫শে জুলাই ২০০০। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের নিকটবর্তী শার্ল দ্যা গল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। প্যারিসে দু’টি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর রয়েছে। এক সময় অরলি বিমান বন্দর দিয়েই আন্তর্জাতিক গন্তব্যে বিমান পরিচালনা করা হত। পরবর্তীতে শার্ল দ্যা গল বিমান বন্দর তৈরি হওয়ার পর অরলির গুরুত্ব অনেক কমে যায়।

দুপুর ১২:৩০:  শার্ল দ্যা গল বিমান বন্দরের এয়ার ফ্রান্স চেক ইন কাউন্টারে বেশ ব্যস্ততা। আজকের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ফ্লাইট ৪৫৯০ এর জন্য চেক ইনের প্রস্তুতি চলছে। আজকের এই ফ্লাইটটি একটি চার্টার্ড ফ্লাইট অর্থাৎ জার্মানির একটি টুরিস্ট সংস্থা পিটার গিলম্যান ক্রুজ এর আয়োজনে বেড়ানোর একটি কর্মসূচীর আওতায় ১০০ জন জার্মান নাগরিক এয়ার ফ্রান্সের এই ফ্লাইটে নিউইয়র্ক যাচ্ছেন। নিউইয়র্কে তাঁরা ক্রুজ শিপ এম এস ডয়েশল্যান্ডে উঠবেন এবং ১৬ দিন পুরো ক্যারিবিয়ানে বেড়ানোর পর ইকুয়েডরের মান্টায় পৌছবেন। অপর কারণটি হল, এই ফ্লাইটে ব্যবহৃত হবে আকাশের রানী হিসেবে খ্যাত কনকর্ড বিমান।

আধুনিক বিমান চলাচল ইতিহাসে কনকর্ড বিমানটিকে একটি বিস্ময় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অন্যান্য বাণিজ্যিক বিমানের চাইতে একেবারেই আলাদা এই বিমানটি প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ২৫০০ কিলোমিটার বেগে উড়তে পারে। আকাশের ৬০ হাজার ফিট উপর দিয়ে মাত্র ৩ ঘণ্টায় এই বিমান লন্ডন থেকে নিউইয়র্কে পৌছাতে পারে যেখানে অন্য বাণিজ্যিক বিমানগুলোর মধ্যে সবচাইতে দ্রুতগতিরটি সময় নেয় প্রায় ৬ ঘণ্টা। ইউরোপ ও আমেরিকার ব্যস্ত ব্যবসায়ীদের কাছে এই বিমানটি সাংঘাতিক জনপ্রিয় তবে কনকর্ডে বিমান যাত্রা খুব একটা আরামপ্রদ নয়। এটির পরিচালনা ব্যয় অত্যন্ত বেশী বিধায় শুধুমাত্র ব্রিটিশ এয়ার ওয়েজ এবং এয়ার ফ্রান্স কনকর্ড বিমান ব্যবহার করে। বিমানটির উৎপাদক বিএসি সাদ এভিয়েশন এ পর্যন্ত মোট ২০টি কনকর্ড বিমান উৎপাদন করেছে যার ১৪টি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিমান চলাচলের ক্ষেত্রে কনকর্ডের রেকর্ড খুব ভাল এবং বিশ্লেষকদের মতে, এই মুহূর্তে কনকর্ডই সবচাইতে নিরাপদ বিমান।

দুপুর ৩:৩০: ফ্লাইট ৪৫৯০ উড্ডয়নের সব প্রস্তুতি শেষ করার পরেও ইঞ্জিন মেকানিকদের নির্দেশে কিছুক্ষণের জন্য যাত্রা স্থগিত করতে হল। মেকানিকরা ডান দিকের ২ নং ইঞ্জিনের রিভার্স থ্রাষ্টারে সমস্যা পেয়েছে। বিমান অবতরণের সময় রিভার্স থ্রাষ্টার পেছন দিকে চাপ সৃষ্টি করে বিমানের গতি কমাতে সাহায্য করে। সমস্যাটি অত্যন্ত ছোট কিন্তু কনকর্ডের নিরাপত্তার জন্য কোন সমস্যাই ছোট নয়। তাই মেকানিকরা ছোট একটি যন্ত্রাংশ বদলে দেয়ার জন্য বিমানটির যাত্রা এক ঘণ্টা বিলম্বিত করা হল। আজকের ফ্লাইটের পাইলট ক্যাপ্টেন ক্রিশ্চিয়ান মার্টি, কো-পাইলট ফার্ষ্ট অফিসার জাঁ মার্কো এবং ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার গিল জার্ডিনাউ যার যার সীটে বসে প্রি-ফ্লাইট চেক সম্পন্ন করেছেন। ৫৪ বছর বয়েসী ক্যাপ্টেন ক্রিশ্চিয়ান মার্টি এয়ার ফ্রান্সের সবচাইতে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন পাইলটদের মধ্যে অন্যতম এবং ফ্রান্সের একজন জাতীয় সেলিব্রেটি। সামুদ্রিক উইন্ড সার্ফিং প্রতিযোগিতায় তিনি ১৯৮২ সনে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন তিনিই প্রথম ফরাসী হিসেবে উইন্ড সার্ফিং নৌকার সাহায্যে আটলান্টিক সাগর পাড়ি দিয়েছিলেন। ফার্ষ্ট অফিসার জাঁ মার্কো এবং ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার জিল জার্ডিনাউ কনকর্ড ফ্লাইট পরিচালনায় খুবই দক্ষ ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন।

বিকেল ৩:৫৪: যাত্রীরা লাইন ধরে কনকর্ড বিমানটিতে আরোহণ করে নির্ধারিত আসন গ্রহণ করলেন। বিমানটিতে ২৫টি সারীতে প্রতিটিতে চারটি করে মোট ১০০টি যাত্রী আসন রয়েছে। ১০০ জন যাত্রীর সেবা প্রদানের জন্য কেবিন ক্রু রয়েছে ৬ জন। 

বিকেল ৪:২৫: নির্ধারিত সময়ের প্রায় এক ঘণ্টা পরে ফ্লাইট ৪৫৯০ উড্ডয়নের জন্য    
২৬ আর রানওয়েতে লাইন আপে এসে দাঁড়াল। কনকর্ডের ঠিক আগের সিডিউলে অপেক্ষা করছে কন্টিনেন্টাল এয়ার লাইন্সের একটি ডিসি ১০ বিমান। কন্টিনেন্টাল ফ্লাইটটি যাবে যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সির নিউওয়ার্ক বিমান বন্দরে।

বিকেল ৪:৩০: কন্টিনেন্টাল এয়ার লাইন্সের ডিসি ১০-৩০ বিমানটি যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সির নিউওয়ার্ক বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে রানওয়ে ত্যাগ করলো।

বিকেল ৪:৩৫: নির্ধারিত সময়ের এক ঘণ্টা পর এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইট ৪৫৯০ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়ার জন্য রানওয়ে ২৬ আর এর ডিপারচার পয়েন্টে এসে দাঁড়াল। শার্ল দ্যা গল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের প্রধান নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার থেকে কনকর্ডের এই যাত্রাটি নিয়ন্ত্রণ করছেন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার জিল লজলাঁ। লজলাঁ শার্ল দ্যা গল বিমান বন্দরের একজন অভিজ্ঞ এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার। আজ তার দায়িত্ব ছিল সকালের ফ্লাইটগুলো সামলানোর কিন্তু বিকেলের শিফটের কন্ট্রোলার কোন সমস্যার কাড়নে জিল লজলাঁর সাথে শিফট বদলে নিয়েছে। লজলাঁ কনকর্ডের ক্যাপ্টেন মার্টির সাথে কথা বলে ফ্লাইট ৪৫৯০ কে যাত্রা শুরুর নির্দেশ দিলে কনকর্ড বিমানটি রানওয়ে দিয়ে দৌড় শুরু করল। টাওয়ার থেকে কন্ট্রোলার লজলাঁ বিমানটির উপর নজর রাখছিলেন। কনকর্ড চার হাজার মিটার দৈর্ঘ্যের রানওয়ের অর্ধেক পাড়ি দিতেই এর গতিবেগ হল ঘণ্টায় ৩২০ কিলোমিটার। এই গতি অর্জনকে বলা হয়ে থাকে পয়েন্ট অব নো রিটার্ন অর্থাৎ এই গতিতে চলন্ত একটি বিমানের পাইলট শুধু একটি কাজই করতে পারেন আর তা হল বিমানটিকে আকাশে তোলা। কনকর্ডের গতিবেগ ৩২০ কিলোমিটার অতিক্রম করতেই কন্ট্রোলার লজলাঁ লক্ষ্য করলেন বিমানটির ডান পাখার নীচ থেকে ধোঁয়া এবং আগুন বেড়িয়ে আসছে। সাথে সাথে তিনি ক্যাপ্টেন মার্টির সাথে রেডিওতে যোগাযোগ করে আগুনের কথা জানালেন। এই সময় কনকর্ডের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৩২৮ কিলোমিটার। ক্যাপ্টেন মার্টি আগুন দেখতে না পেলেও দুটি ইঞ্জিনের শক্তি হঠাৎ করে কমে যাওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারছিলেন। কিন্তু এ সময় ক্যাপ্টেন মার্টির কিছুই করার ছিল না।

বিকেল ৪:৪৩:১৫: ক্যাপ্টেন মার্টি কন্ট্রোল কলামটি নিজের দিকে টেনে নিতেই কনকর্ড মাথা উঁচু করে আকাশে উঠে গেল। ডান দিকের বিশাল ডানার নীচে তখন প্রচণ্ড আগুন জ্বলছিল এবং পেছনে আগুন ও ধোঁয়ার বিশাল স্তম্ভ নিয়ে বিমানটি উপরে উঠার চেষ্টা করছিল।

বিকেল ৪:৪৩:৩০: মাটি থেকে মাত্র ৯০ মিটার উপরে উঠা বিমানটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ক্যাপ্টেন মার্টি হিমশিম খাচ্ছিলেন। বিমানটি ক্রমশ: বাম দিকে হেলে পরছিল এবং ডান দিকের ইঞ্জিন দুটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ক্যাপ্টেন মার্টি এবং ফার্ষ্ট অফিসার মার্কো বিমানটিকে নিকটবর্তী লে বোর্জ বিমান বন্দরে অবতরণ করানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে আগুনের বিস্তার এত বেশী হয়ে পরেছে যে তাঁদের সব চেষ্টাই বিফলে গেল। হঠাৎ করে ডান দিকের ডানাটি বিমান থেকে খুলে নীচে পরে যায়।

বিকেল ৪:৪৫: ডান দিকের ডানার নীচের ইঞ্জিন দুটো সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যেতেই কনকর্ডের গতি কমতে শুরু করে এবং ডানা খুলে যাওয়ার পর মুহূর্তের মধ্যেই বিমানটি খাড়া হয়ে নীচের দিকে পরে যেতে থাকে। ১০ সেকেন্ডের মধ্যে বিমানটি নীচে অবস্থিত লে রেলিস ব্লিউস নামের একটি হোটেল বিল্ডিং এর উপর পরে বিস্ফোরিত হল।

শার্ল দ্যা গল বিমান বন্দরের টাওয়ার থেকে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার জিল লজলাঁ দুর্ঘটনাটি পুরোপুরি দেখতে পেলেন। কনকর্ডের মত এত নিরাপদ একটি বিমান এভাবে দুর্ঘটনায় পরতে পারে তা কোনভাবেই বিশ্বাস হচ্ছিল না তাঁর। বলতে গেলে সমগ্র টাওয়ারটিই ক’ মিনিটের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।

ফ্রান্স ও গ্রেট ব্রিটেনের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তির আওতায় ফ্রান্সের এরোষ্পেসিয়েল এবং ব্রিটিশ এয়ারক্রাফট কর্পোরেশনের যৌথ উদ্যোগে উৎপাদিত সুপারসনিক ট্রান্সপোর্ট বা এসএসটি কনকর্ড ১৯৬৯ সনে প্রথম আকাশে উড়ে। ১৯৭৬ সনে কনকর্ড বাণিজ্যিক যাত্রী পরিবহন শুরু করে। ১৯৭৬ থেকে ২০০০, এই ২৪ বছরে কনকর্ড এর মাধ্যমে অসংখ্য ফ্লাইট পরিচালিত হয়েছে কিন্তু বড় ধরনের দুর্ঘটনা এই প্রথম ঘটল। দুর্ঘটনার মাধ্যমে কনকর্ড বিমান ধংস হয়ে গেছে, এই সংবাদটি বিশ্বাস করতে অনেকেরেই কষ্ট হয়েছিল। তারপরও বাস্তবতা এই ছিল যে প্যারিসের শার্ল দ্যা গল বিমান বন্দর থেকে উড্ডয়নের দু মিনিটের মধ্যেই এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইট ৪৫৯০ দুর্ঘটনায় পরে এবং ১০৯ জন আরোহী সহ কনকর্ড বিমানটি সম্পূর্ণরূপে ধংস হয়ে যায়। প্যারিসের গিনেজ এলাকায় অবস্থিত যে হোটেলটির উপর কনকর্ড বিধ্বস্ত হয় তার ৪ জন কর্মীও একই সাথে নিহত হন।

কনকর্ড বিধ্বস্ত হওয়ার সাথে সাথে উদ্ধার কর্মীরা ছুটে আসে কিন্তু প্রজ্বলিত ধংসাবশেষে প্রচণ্ড তাপের কাড়নে উদ্ধারকাজ বিলম্বিত হয়। উদ্ধার কাজ শেষ হতে প্রায় ৪৮ ঘণ্টা সময় লাগে এবং উদ্ধার সম্পন্ন হওয়ার পর দেখা যায় প্রচণ্ড তাপে মৃতদেহগুলো এমনভাবে বিকৃত হয়েছে যে বিমানের কোন যাত্রী বা ক্রুদের পৃথকভাবে সনাক্ত করা সম্ভব নয়।

প্যারিসের শার্ল দ্যা গল বিমান বন্দরের কাছে কনকর্ডের দুর্ঘটনার পরবর্তীতে ফ্রান্স কর্তৃপক্ষ কনকর্ডের সবগুলো বিমান পরিচালনা স্থগিত ঘোষণা করে এবং ফ্রান্সের এয়ার এক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো এই দুর্ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব গ্রহণ করে। 
দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্য

Monday, July 1, 2013

মে ডে: দিল্লীর মধ্য আকাশে সংঘর্ষ- ইতিহাসের তৃতীয় ভয়ংকরতম বিমান দুর্ঘটনা-শেষ পর্ব























১২ই নভেম্বর ১৯৯৬ সন্ধ্যা ৭ টা। ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লীর ইন্দিরা গান্ধি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর এর গ্রাউন্ড এবং এপ্রোচ, উভয় নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারেই প্রচণ্ড উত্তেজনা। দিল্লী থেকে ৬৫ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত চরখি দাদ্রি গ্রামের সরিষা ও আলু ক্ষেতে কিছুক্ষণ আগে ভেঙ্গে পরা দুইটি যাত্রীবাহী বিমানের ধংসস্তুপে প্রচণ্ড আগুন জ্বলছে। আকাশের ১৪ হাজার ফিট উপরে বিমান দুটির মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সাউদিয়া এয়ার লাইন্সের ফ্লাইট এসভিএ ৭৬৩ দ্বিতল জাম্বোজেট বোয়িং ৭৪৭-১৬৮বি বিমানটির একটি পাখা কাজাখস্থান এয়ার লাইন্সের ফ্লাইট কেজেডএ ১৯০৭ এর টেইল সেকশনের হরাইজন্টাল ষ্ট্যাবিলাইজারে ধাক্কা মারে। ফলে উভয় বিমানই বিস্ফোরিত হয় এবং সাউদিয়ার বোয়িং ৭৪৭ বিমানটি পাক খেতে খেতে ঘণ্টায় প্রায় ১১ শ কিলোমিটার বেগে চরখি দাদ্রি গ্রামের ক্ষেতের উপর আছরে পরে। সংঘর্ষের প্রচণ্ডতায় বোয়িং ৭৪৭ বিমানটির ককপিট মাটির অনেক গভীরে ঢুকে যায়। কাজাখ এয়ার লাইন্সের ইলিউশিন টু ৭৬ টিডি বিমানটি সাউদিয়া বিমানের প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে মাটিতে আছরে পরে। সৌদি ও কাজাখ বিমান দুর্ঘটনায় উভয় বিমানের যাত্রী ও ক্রু মিলিয়ে মোট ৩৪৯ জনের মৃত্যু হয়।

বিমান দুর্ঘটনার সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথে ভারত সরকারের এয়ার এক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্রাঞ্চের তদন্তকারীরা ইন্দিরা গান্ধি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের এপ্রোচ কন্ট্রোলে চলে আসেন। প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁদের দৃষ্টি রয়েছে এপ্রোচ কন্ট্রোলার বি কে দত্তের দিকে। হয়তো তার কোন ভুলের কারণেই বিমান দুটি একই উচ্চতায় থেকে পরস্পরকে ধাক্কা মেরেছে। তবে সবার আগে বিমান দুর্ঘটনা তদন্তকারীদের যেতে হবে চরখি দাদ্রি গ্রামে যেখানে বিমান দুটো ভেঙ্গে পরেছে। সকাল হতেই ক্যাপ্টেন কেপিএস নায়ারের নের্তৃত্বে এয়ার এক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্রাঞ্চের তদন্তকারী দলটি দুর্ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন।  সাউদিয়ার বোয়িং এবং কাজাখ ইলিউশিন বিমান দুটি পরস্পরের ৭ কিলোমিটার দূরত্বে আছরে পরেছে। সুতরাং তদন্তকারীদেরকে দু জায়গাতেই তদন্ত চালাতে হবে। তদন্তের প্রথমেই বিমান দুটির ব্ল্যাক বক্স বা ককপিট ভয়েস রেকর্ডার এবং ফ্লাইট ড্যাটা রেকর্ডার উদ্ধারের জন্য চেষ্টা চলে এবং প্রথম দিনেই বিমান দুটির ধংসস্তুপ থেকে ব্ল্যাক বক্স দুটি উদ্ধার করা হয়। ফ্লাইট ড্যাটা রেকর্ডার থেকে তথ্য সংগ্রহ করা অনেক জটিল ও সময় সাপেক্ষ কাজ বিধায় তদন্তকারীরা প্রথমেই দুটি বিমানের ককপিট ভয়েস রেকর্ডার ও এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের ট্রান্সক্রিপ্ট পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। ইন্দিরা গান্ধি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে বিমান নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় সেকেন্ডারি সার্ভিল্যান্স রাডার না থাকায় আকাশে বিমানের অবস্থান জানার জন্য এপ্রোচ কন্ট্রোলাররা বিমানের পাইলট অথবা রেডিও অপারেটরের উপর সম্পূর্ণ ভাবে নির্ভর করেন। অর্থাৎ বিমানের পাইলট যদি জানায় যে বিমানটি ১০ হাজার ফিট উচ্চতায় রয়েছে তবে কন্ট্রোলার এটিকেই বিমানের প্রকৃত উচ্চতা হিসেবে মেনে নেন এবং একটি কাগজে লিখে রাখেন। পাইলট যদি কোন কারণে উচ্চতার হিসাবে ভুল করেন তবে কন্ট্রোলারের তা জানার কথা নয়। ককপিট ভয়েস রেকর্ডারে পাইলট অথবা রেডিও অপারেটরের মধ্যে তথ্য আদান প্রদান এবং ককপিটের ভেতরে ক্রুদের কথোপকথন রেকর্ড হয়। ফ্লাইট ড্যাটা রেকর্ডার বিমান চলার প্রতিটি মুহূর্তে যন্ত্রপাতি কি কাজ করছে, আবহাওয়া কি ধরনের আচরণ করছে এই সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রেকর্ড করে।

ধংসপ্রাপ্ত বিমান দুটির ককপিট ভয়েস রেকর্ডার হাতে আসার সাথে সাথেই ভারতীয় এয়ার এক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্রাঞ্চের তদন্তকারী দলের প্রধান ক্যাপ্টেন কেপিএস নায়ার এপ্রোচ কন্ট্রোলার ভি কে দত্তকে ডেকে পাঠালেন। উদ্দেশ্য, দুর্ঘটনাটির সাথে দত্তের সম্পর্ক কতটুকু তা বিশদভাবে জানা।  যে কোন বিমান দুর্ঘটনার জন্য মূলত: তিনটি কাড়নই মুখ্য থাকে। যেমন:

১। বিমান নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এপ্রোচ কন্ট্রোলারের কোন ভুল নির্দেশ অথবা ভুল পদক্ষেপ

২। বিমানের ক্রুদের পক্ষ থেকে বিমান পরিচালনায় ভুল

৩। বিমানের কোন যান্ত্রিক ত্রুটি।

তদন্ত দলের কাছে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দুর্ঘটনা পূর্ববর্তী এবং দুর্ঘটনার সময়কার উভয় বিমানের পাইলট, রেডিও অপারেটর এবং এপ্রোচ কন্ট্রোলারের মধ্যকার কথোপকথন। তাই তাঁরা দুদিন ধরে এপ্রোচ কন্ট্রোলার ভি কে দত্তের সাক্ষাতকার নিলেন। পরে তার বক্তব্যগুলো দুর্ঘটনা সময়কার এপ্রোচ কন্ট্রোল ম্যানুসস্ক্রিপ্টের সাথে মিলিয়ে দেখা হল।  প্রমাণিত হল যে সাউদিয়া এবং কাজাখ বিমান দুটি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ভি কে দত্তের সব পদক্ষেপ সঠিক ছিল এবং তার কোন কাজ অথবা কথা দুর্ঘটনার সাথে কোন ভাবেই জড়িত নয়। ভি কে দত্ত কে রেহাই দিয়ে তদন্তকারীরা ধংসপ্রাপ্ত বিমান দুটির উদ্ধার করা যন্ত্রাংশগুলো পরীক্ষা করা শুরু করলেন। ইতোমধ্যে ধংসাবশেষ থেকে বিমান দুটির আল্টিমেটার উদ্ধার করা হয়েছে। আল্টিমেটার উড়ন্ত অবস্থায় বিমানের উচ্চতা পরিমাপ করে। পরীক্ষার মাধ্যমে একটি বিস্ময়কর তথ্য বেড় হয়ে এলো। সাউদিয়া বিমানটির আল্টিমিটারে দেখা যাচ্ছে সংঘর্ষের সময় বিমানটি ১৪১১০ ফিট উচ্চতায় উড়ছিল এবং কাজাখ বিমানটির উচ্চতা ছিল ১৪১০৮ ফিট। এটি অত্যন্ত বিস্ময়কর তথ্য কারণ ভি কে দত্তের বক্তব্য এবং ফ্লাইট কন্ট্রোল ম্যানুসক্রিপ্ট অনুযায়ী সাউদিয়ার উচ্চতা সঠিক হলেও কাজাখ বিমানটি তার জন্য বেঁধে দেয়া সুনির্দিষ্ট উচ্চতা থেকে প্রায় ১ হাজার ফিট নীচ দিয়ে উড়ছিল।  এমনকি যে কোন কারণে কাজাখ বিমানটি সাউদিয়ার নীচে চলে এসেছিল। পরবর্তীতে ফ্লাইট ড্যাটা রেকর্ডার পরীক্ষা করেও প্রমাণিত হল যে সংঘর্ষের সময় কাজাখ বিমানটি সাউদিয়ার ২ ফিট নীচে ছিল। তদন্তকারীরা অবশেষে দুর্ঘটনার কারণটি বুঝতে পারলেন। এপ্রোচ কন্ট্রোলার ভি কে দত্ত সুস্পষ্টভাবে সাউদিয়া ফ্লাইট এসভিএ ৭৬৩ এর জন্য ১৪ হাজার ফিট উচ্চতা এবং কাজাখ ফ্লাইট ১৯০৭ এর জন্য ১৫ হাজার ফিট নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল। সুতরাং এপ্রোচ কন্ট্রোলের ধারনা ছিল কাজাখ ফ্লাইট ও সাউদিয়া পরস্পরকে অতিক্রম কালে দুটি বিমানের মধ্যে প্রায় ১ হাজার ফিট দূরত্ব থাকবে।  কিন্তু কোন অজানা কারণে কাজাখ ফ্লাইটটি তার জন্য নির্দিষ্ট ১৫ হাজার ফিট উচ্চতা থেকে নেমে ১৪ হাজার ফিটে চলে আসে এবং একই উচ্চতায় উড়ন্ত বোয়িং ৭৪৭ বিমানটির সাথে ধাক্কা খায়।

দুর্ঘটনার মূল রহস্যটি উদ্ঘাটিত হলেও কাজাখ ফ্লাইটের পাইলট কি কারণে বরাদ্দ উচ্চতা থেকে ১ হাজার ফিট নীচে চলে এসেছিল সে বিষয়ে জানতে তদন্তকারীরা পুনরায় ককপিট ভয়েস রেকর্ডারের শরণাপন্ন হলেন। প্রথম থেকেই সাউদিয়ার বোয়িং ৭৪৭-১৬৮বি এবং কাজাখ এয়ারের ইলিউশিন ৭৬ বিমান দুইটির সাথে এপ্রোচ কন্ট্রোলের কথোপকথন পুনরায় শোনা হল:

সাউদিয়া ৭৬৩;-  লেভেল ১৪০ (১৪ হাজার ফিট) এ পৌঁছে যাচ্ছি।  আরও উপরে  উঠার অনুমতি চাইছি।

এপ্রোচ কন্ট্রোল;- লেভেল ১৪০ তে স্থির থেকে এগিয়ে যান।

সাউদিয়া ৭৬৩;- লেভেল ১৪০ এ থাকছি।

এপ্রোচ কন্ট্রোলার ভি কে দত্ত চাচ্ছিলেন সাউদিয়া ফ্লাইটটিকে ১৪০ লেভেল অর্থাৎ ১৪ হাজার ফিট উচ্চতায় রেখে বিপরীত দিক থেকে আগত কাজাখ ফ্লাইটটিকে ১৫০ লেভেল অর্থাৎ ১৫ হাজার ফিট দিয়ে অতিক্রম করাতে। দত্তের এই পদক্ষেপ অত্যন্ত সঠিক ছিল।

তদন্তকারীরা এবার মনোযোগ দিলেন কাজাখ ফ্লাইটের সাথে দত্তের কথোপকথনের উপর। যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং অথবা ইউরোপের এয়ারবাস কর্তৃক তৈরি বিমানগুলোতে ক্যাপ্টেন অথবা ফার্ষ্ট অফিসার এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সাথে সরাসরি রেডিও যোগাযোগ করে। কিন্তু রাশিয়ার যাত্রীবাহী বিমানগুলো প্রথমত মিলিটারী ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। পরে এই বিশালাকায় বিমানগুলো দিয়ে রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন দেশগুলো বাণিজ্যিকভাবে যাত্রী পরিবহন শুরু করলেও এগুলোর ককপিটের কোন পরিবর্তন করা হয় নি। ফলে ইলিউশিন জাতীয় বিমানগুলোতে রেডিও যোগাযোগের দায়িত্ব থাকে রেডিও অপারেটরের উপর। আর রেডিও অপারেটরের বসার যায়গা থাকে ফার্ষ্ট অফিসারের পেছনে  যেখানে কোন উচ্চতা মাপক আল্টিমেটার থাকে না। ফলে বিমানের উচ্চতা বুঝতে হলে রেডিও অপারেটরকে পাইলট অথবা ফার্ষ্ট অফিসারের সম্মুখে অবস্থিত আল্টিমিটারের দিকে কষ্ট করে তাকাতে হয়। এ ছাড়া সাবেক রাশিয়ান দেশগুলোর বাণিজ্যিক বিমান সংস্থার বেশীর ভাগ ক্রুরা ইংরেজি জানে না ফলে সম্পূর্ণ যোগাযোগের দায়িত্ব থাকে রেডিও অপারেটরের উপর। অর্থাৎ পাইলট এবং এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলাররা তথ্য বিনিময় করে থাকে রেডিও অপারেটরদের মাধ্যমে। কাজাখ ফ্লাইট ১৯০৭ এর ক্ষেত্রেও রেডিও যোগাযোগের দায়িত্ব ছিল রেডিও অপারেটর আইগর রেপ এর উপর।

আইগর রেপ: কাজাখ ১৯০৭ থেকে বলছি। আমরা ১৫০ লেভেল এ পৌঁছে গেছি। পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষায় আছি।

এপ্রোচ কন্ট্রোল: ১৫০ লেভেলে স্থির থেকে এগিয়ে আসুন তবে বিপরীত থেকে সৌদি বোয়িং ৭৪৭ আপনাদের দিকে এগিয়ে আসছে। এই মুহূর্তে বিমানটি আপনাদের থেকে দশ মাইল দূরে আছে। লক্ষ্য রাখুন এবং বিমানটি দেখা মাত্রই আমাকে জানান।

আইগর রেপ: ১৫০ লেভেলে স্থির থেকে এগিয়ে আসছি। সৌদি বিমানটি কত মাইলের মধ্যে আছে?

এপ্রোচ কন্ট্রোল: সৌদি বিমান এই মুহূর্তে আট মাইলের মধ্যে আছে। লক্ষ্য রাখুন।

দশ সেকেন্ড পর এপ্রোচ কন্ট্রোলার দত্ত পুনরায় কাজাখ বিমানটির সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলো কিন্তু কোন জবাব পেল না। দত্ত সাউদিয়া ফ্লাইটের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল। ঠিক এই সময়েই লকহীড সি-১৪১বি ষ্টারলিফ্টার বিমানটির ক্যাপ্টেন টিমোথী জে প্লেস এপ্রোচ কন্ট্রোলকে বিস্ফোরণের বিষয়টি জানালেন।
তদন্তকারীরা নিশ্চিত হলেন যে কোন এক অজানা কারণে কাজাখ বিমানটি এপ্রোচ কন্ট্রোল থেকে বরাদ্দ করা ১৫০ লেভেল থেকে ১৪০ লেভেলে নেমে এসেছিল কিন্তু রেডিও অপারেটর আইগর রেপ বিষয়টি বুঝতে পারে নি বিধায় সে জানায় যে বিমানটি ১৫ হাজার ফিটে এসে স্থির হয়েছে।

সাউদিয়া এবং কাজাখ বিমানের মুখোমুখি দুর্ঘটনার পর তিন মাস কেটে গেছে। ভারতীয় তদন্তকারীরা এখন নিশ্চিতভাবে দুর্ঘটনার কারণটি জানেন কিন্তু কোন বিমানটি এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী তা বুঝতে হলে নিরপেক্ষভাবে সিভিআর এবং এফডিআর পরীক্ষা করা প্রয়োজন। তাই নিরপেক্ষ বিশ্লেষণের উদ্দেশ্যে দুর্ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধারকৃত যন্ত্র দুটি ইংল্যান্ডে প্রেরণ করা হল। ব্ল্যাক বক্স বিশেষজ্ঞ পিটার শেফার্ড যন্ত্র দুটো থেকে সব ধরনের তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব পেলেন।  বিশ্লেষণের শুরুতেই সাউদিয়া ফ্লাইটের ককপিট ভয়েস রেকর্ডার এবং ফ্লাইট ড্যাটা রেকর্ডারের তথ্য মিলিয়ে দেখে জানা গেল সাউদিয়ার পাইলট এবং কো-পাইলট সব ধরনের নিয়ম মেনে এপ্রোচ কন্ট্রোলের নির্দেশে ১৪ হাজার ফিট উচ্চতায় এসে বিমানটিকে স্থির করে ঘণ্টায় প্রায় ৮ শ কিলোমিটার বেগে এগিয়ে যেতে থাকেন। এ থেকে প্রমাণ হয় যে দুর্ঘটনার জন্য সাউদিয়ার বিমানটি কোনভাবেই দায়ী নয়। এবার কাজাখ ফ্লাইটের ব্ল্যাক বক্স বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটি গুরুতর অসঙ্গতি পেলেন পিটার শেফার্ড। দেখা গেল, কাজাখ ফ্লাইটের রেডিও অপারেটর যখন জানায় যে তার বিমান ১৫ হাজার ফিট উচ্চতায় নেমে এসেছে তখন প্রকৃত পক্ষে উচ্চতা ছিল ১৪৫০০ ফিট এবং এপ্রোচ কন্ট্রোলের ১৫ হাজার ফিটে স্থির হওয়ার নির্দেশ অমান্য করে বিমানটি আরও নামতে থাকে এবং এক পর্যায়ে বিমানটি ১৪ হাজার ফিটে চলে আসে কিন্তু হঠাৎ করে পাইলট বিমানের গতি বাড়িয়ে উপরের দিকে উঠার চেষ্টা করলেই সাউদিয়ার বিমানটির সাথে সংঘর্ষ হয়। ফ্লাইট বক্স বিশ্লেষণ করে তদন্ত দল দুর্ঘটনার বিষয়ে বিষদ জানতে পারেন।

কি ভাবে দুর্ঘটনাটি ঘটল?

সন্ধ্যা ৬:৩২ মিনিট। গ্রাউন্ড কন্ট্রোলের অনুমতি পেয়েই সাউদিয়া ফ্লাইট এসভি ৭৬৩ রানওয়ে ত্যাগ করে আকাশে উঠে গেলে এপ্রোচ কন্ট্রোলার ভি কে দত্ত এর নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এ সময় তার নিয়ন্ত্রণে থাকা পাঁচটি ফ্লাইটের মধ্যে তিনটি ছিল অগ্রধীকারপ্রাপ্ত। দুটি বিমান অবতরণের জন্য আসছিল এবং একটি বিমান বন্দর ত্যাগ করে উপরের দিকে যাচ্ছিল।  

সন্ধ্যে ৬:৩৯ মিনিট। সাউদিয়া ৭৬৩ এর কমান্ডার ক্যাপ্টেন খালিদ এপ্রোচ কন্ট্রোলকে জানালেন যে তিনি প্রত্যাশিত ১৪ হাজার ফিটে পৌঁছে গেছেন এবং আরও উপরে উঠার অনুমতি চাইছেন। বি কে দত্ত ক্যাপ্টেন খালিদকে ১৪ হাজার ফিট উচ্চতা বজায় রাখার নির্দেশ দিল।

সন্ধ্যে ৬:৪০ মিনিট। কাজাখ ফ্লাইট ১৯০৭ থেকে রেডিও কন্ট্রোলার আইগর রেপ এপ্রোচ কন্ট্রোলকে জানালেন যে তিনি তাঁর জন্য নির্ধারিত ১৫ হাজার ফিট উচ্চতায় নেমে এসেছেন। কিন্তু এই সময় কাজাখ ফ্লাইটের উচ্চতা ছিল ১৪৫০০ ফিট। এপ্রোচ কন্ট্রোলার আইগর রেপকে ১৫ হাজার ফিট উচ্চতায় স্থির হওয়ার নির্দেশ দিয়ে বিপরীত দিক থেকে আগত সাউদিয়া ফ্লাইট সম্বন্ধে জানাল।

সন্ধ্যে ৬:৪০:১০ সেকেন্ড: সাউদিয়া ফ্লাইট ৭৬৩ উড়ছে ১৪১১০ ফিট উচ্চতায় আর কাজাখ ফ্লাইট নেমে এসেছে ১৪১০০ ফিটে। রেডিও অপারেটর এই সময় উচ্চতা জনিত ভুলটি বুঝতে পেরে পাইলটকে ১৫ হাজার ফিটে উঠে যাওয়ার পরামর্শ দিলে ক্যাপ্টেন গেন্নাদী ইঞ্জিনের শক্তি বৃদ্ধি করে উপরে উঠার চেষ্টা করলেন।

সন্ধ্যে ৬:৪০:১১ সেকেন্ড: কাজাখ ফ্লাইট ১৪১০৮ ফিটে আসতেই বিপরীত দিক থেকে আসা সাউদিয়া বিমানের বা দিকের ডানার সাথে কাজাখ বিমানের টেইল সেকশনের হরাইজন্টাল ষ্ট্যাবিলাইজারের ধাক্কা লাগল। সাথে সাথে সাউদিয়ার বা দিকের ডানা বিস্ফোরিত হয়ে আগুন ধরে গেল এবং বিমানটি পাক খেতে খেতে ঘণ্টায় প্রায় ১১ শ কিলোমিটার বেগে মাটিতে আছরে পরল। এ সময় মৃত্যু সম্মুখে দেখে ফার্ষ্ট অফিসার নজর খান পবিত্র কলেমা শাহাদাত (আশ্শাহাদু লাইলাহা ইল্লারাহ-) পড়তে থাকেন। সংঘর্ষে কাজাখ ফ্লাইটের হরাইজন্টাল ষ্ট্যাবিলাইজার ভেঙ্গে গেলে বিমানটি কিছুদূর এগিয়ে সাউদিয়া বিমান থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে মাটিতে আছরে পরে ধংস হয়ে যায়।

দুর্ঘটনার প্রায় পাঁচ মাস পর তদন্ত রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়। এতে কাজাখ ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন গেন্নাদী এবং রেডিও অপারেটর রেপকে সম্পূর্ণভাবে দায়ী করা হয় দুর্ঘটনাটির জন্য। রিপোর্টে জানানো হয় যে এপ্রোচ কন্ট্রোলের সুনির্দিষ্ট নির্দেশ থাকা সত্বেও কাজাখ ফ্লাইটটি ১৫ হাজার ফিট থেকে ১৪ হাজার ফিটে নেমে আসার কারণেই দুর্ঘটনাটি ঘটে। এপ্রোচ কন্ট্রোলের নির্দেশ অমান্য করে কাজাখ ফ্লাইটের নীচে চলে আসাকে একটি বোঝার ভুল হিসেবে চিন্হিত করে কাজাখ ক্যাপ্টেন এবং রেডিও অপারেটরের দুর্বল ইংরেজি ভাষা জ্ঞান ও ইলিউশিন বিমানটির অনুপযুক্ত রেডিও কমিউনিকেশন ব্যবস্থাকে দায়ী করা হয়। এ ছারা, দুর্ভাগ্যের বিষয়েও কিছুটা আলোকপাত করা হয় রিপোর্টে। কাজাখ বিমানটি নীচে নামতে নামতে এক পর্যায়ে সাউদিয়া বিমানের ১০ ফিট নীচে চলে আসে। যদি ক্যাপ্টেন গেন্নাদী তাঁর নীচে নামার এই প্রবণতা অব্যাহত রাখতেন তাহলে সাউদিয়া বিমানটি নিরাপদ উচ্চতা দিয়ে কাজাখ বিমানটিকে অতিক্রম করত বিধায় দুর্ঘটনাটি এড়ানো যেত। কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে রেডিও অপারেটর নির্ধারিত উচ্চতার নীচে থাকার বিষয়টি বুঝতে পেরে ক্যাপ্টেনকে উপরে উঠার পরামর্শ দিলে তিনি উপরে উঠার চেষ্টা করেন ফলে এই দুর্ঘটনাটি ঘটে।কিন্তু কাজাখ বিমানের ক্যাপ্টেন নির্ধারিত ১৫ হাজার ফিট থেকে কেন ১৪ হাজার ফিটে নেমে এলেন এই বিষয়টি বোঝাই ছিল সবচাইতে কঠিন। তদন্তকারীরা ধারনা করলেন হয় কাজাখ বিমানটির উচ্চতা নিরুপনকারী যন্ত্রের ত্রুটির কারনে ক্যাপ্টেন সঠিক বুঝতে পারেন নি অথবা দূর্বল ইংরেজী জ্ঞানের কারনে রেডিও অপারেটর এপ্রোচ কন্ট্রোলারের নির্দেশ সঠিকভাবে বুঝতে পারে নি। তবে প্রকৃত কারনটি হয়তো কখনও জানা যাবে না।

১৯৯৬ সনের নভেম্বর মাসে সংঘটিত সাউদিয়া-কাজাখ বিমান দুর্ঘটনার পরে ভারতীয় বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ নয়াদিল্লীর ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে সেকেন্ডারি সার্ভিল্যান্স রাডার স্থাপন করে ফলে এপ্রোচ কন্ট্রোলাররা এখন রাডারে বিমানের পরিচিতি, উচ্চতা এবং গতি বিষয়ে তথ্য একই সাথে দেখতে পারেন। দুর্ঘটনার সময় বিমানবন্দরের তিনটি করিডোরের মধ্যে দুটি সামরিক ব্যবহারের জন্য রিজার্ভ রেখে একটি করিডোর বাণিজ্যিক বিমানের জন্য ব্যবহৃত হত। এখন ২টি করিডোর বাণিজ্যিক বিমানের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে এবং ভারত সরকার প্রতিটি বিমানে টি-ক্যাস বা ট্রাফিক কলিশন এভয়েডেন্স সিষ্টেম যন্ত্র স্থাপন বাধ্যতামূলক করেছে।