২৫শে জুলাই ২০০০। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের নিকটবর্তী শার্ল দ্যা গল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। প্যারিসে দু’টি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর রয়েছে। এক সময় অরলি বিমান বন্দর দিয়েই আন্তর্জাতিক গন্তব্যে বিমান পরিচালনা করা হত। পরবর্তীতে শার্ল দ্যা গল বিমান বন্দর তৈরি হওয়ার পর অরলির গুরুত্ব অনেক কমে যায়।
দুপুর ১২:৩০: শার্ল দ্যা গল বিমান বন্দরের এয়ার ফ্রান্স চেক ইন কাউন্টারে বেশ ব্যস্ততা। আজকের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ফ্লাইট ৪৫৯০ এর জন্য চেক ইনের প্রস্তুতি চলছে। আজকের এই ফ্লাইটটি একটি চার্টার্ড ফ্লাইট অর্থাৎ জার্মানির একটি টুরিস্ট সংস্থা পিটার গিলম্যান ক্রুজ এর আয়োজনে বেড়ানোর একটি কর্মসূচীর আওতায় ১০০ জন জার্মান নাগরিক এয়ার ফ্রান্সের এই ফ্লাইটে নিউইয়র্ক যাচ্ছেন। নিউইয়র্কে তাঁরা ক্রুজ শিপ এম এস ডয়েশল্যান্ডে উঠবেন এবং ১৬ দিন পুরো ক্যারিবিয়ানে বেড়ানোর পর ইকুয়েডরের মান্টায় পৌছবেন। অপর কারণটি হল, এই ফ্লাইটে ব্যবহৃত হবে আকাশের রানী হিসেবে খ্যাত কনকর্ড বিমান।
আধুনিক বিমান চলাচল ইতিহাসে কনকর্ড বিমানটিকে একটি বিস্ময় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অন্যান্য বাণিজ্যিক বিমানের চাইতে একেবারেই আলাদা এই বিমানটি প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ২৫০০ কিলোমিটার বেগে উড়তে পারে। আকাশের ৬০ হাজার ফিট উপর দিয়ে মাত্র ৩ ঘণ্টায় এই বিমান লন্ডন থেকে নিউইয়র্কে পৌছাতে পারে যেখানে অন্য বাণিজ্যিক বিমানগুলোর মধ্যে সবচাইতে দ্রুতগতিরটি সময় নেয় প্রায় ৬ ঘণ্টা। ইউরোপ ও আমেরিকার ব্যস্ত ব্যবসায়ীদের কাছে এই বিমানটি সাংঘাতিক জনপ্রিয় তবে কনকর্ডে বিমান যাত্রা খুব একটা আরামপ্রদ নয়। এটির পরিচালনা ব্যয় অত্যন্ত বেশী বিধায় শুধুমাত্র ব্রিটিশ এয়ার ওয়েজ এবং এয়ার ফ্রান্স কনকর্ড বিমান ব্যবহার করে। বিমানটির উৎপাদক বিএসি সাদ এভিয়েশন এ পর্যন্ত মোট ২০টি কনকর্ড বিমান উৎপাদন করেছে যার ১৪টি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিমান চলাচলের ক্ষেত্রে কনকর্ডের রেকর্ড খুব ভাল এবং বিশ্লেষকদের মতে, এই মুহূর্তে কনকর্ডই সবচাইতে নিরাপদ বিমান।
দুপুর ৩:৩০: ফ্লাইট ৪৫৯০ উড্ডয়নের সব প্রস্তুতি শেষ করার পরেও ইঞ্জিন মেকানিকদের নির্দেশে কিছুক্ষণের জন্য যাত্রা স্থগিত করতে হল। মেকানিকরা ডান দিকের ২ নং ইঞ্জিনের রিভার্স থ্রাষ্টারে সমস্যা পেয়েছে। বিমান অবতরণের সময় রিভার্স থ্রাষ্টার পেছন দিকে চাপ সৃষ্টি করে বিমানের গতি কমাতে সাহায্য করে। সমস্যাটি অত্যন্ত ছোট কিন্তু কনকর্ডের নিরাপত্তার জন্য কোন সমস্যাই ছোট নয়। তাই মেকানিকরা ছোট একটি যন্ত্রাংশ বদলে দেয়ার জন্য বিমানটির যাত্রা এক ঘণ্টা বিলম্বিত করা হল। আজকের ফ্লাইটের পাইলট ক্যাপ্টেন ক্রিশ্চিয়ান মার্টি, কো-পাইলট ফার্ষ্ট অফিসার জাঁ মার্কো এবং ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার গিল জার্ডিনাউ যার যার সীটে বসে প্রি-ফ্লাইট চেক সম্পন্ন করেছেন। ৫৪ বছর বয়েসী ক্যাপ্টেন ক্রিশ্চিয়ান মার্টি এয়ার ফ্রান্সের সবচাইতে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন পাইলটদের মধ্যে অন্যতম এবং ফ্রান্সের একজন জাতীয় সেলিব্রেটি। সামুদ্রিক উইন্ড সার্ফিং প্রতিযোগিতায় তিনি ১৯৮২ সনে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন তিনিই প্রথম ফরাসী হিসেবে উইন্ড সার্ফিং নৌকার সাহায্যে আটলান্টিক সাগর পাড়ি দিয়েছিলেন। ফার্ষ্ট অফিসার জাঁ মার্কো এবং ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার জিল জার্ডিনাউ কনকর্ড ফ্লাইট পরিচালনায় খুবই দক্ষ ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন।
বিকেল ৩:৫৪: যাত্রীরা লাইন ধরে কনকর্ড বিমানটিতে আরোহণ করে নির্ধারিত আসন গ্রহণ করলেন। বিমানটিতে ২৫টি সারীতে প্রতিটিতে চারটি করে মোট ১০০টি যাত্রী আসন রয়েছে। ১০০ জন যাত্রীর সেবা প্রদানের জন্য কেবিন ক্রু রয়েছে ৬ জন।
বিকেল ৪:২৫: নির্ধারিত সময়ের প্রায় এক ঘণ্টা পরে ফ্লাইট ৪৫৯০ উড্ডয়নের জন্য
২৬ আর রানওয়েতে লাইন আপে এসে দাঁড়াল। কনকর্ডের ঠিক আগের সিডিউলে অপেক্ষা করছে কন্টিনেন্টাল এয়ার লাইন্সের একটি ডিসি ১০ বিমান। কন্টিনেন্টাল ফ্লাইটটি যাবে যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সির নিউওয়ার্ক বিমান বন্দরে।
বিকেল ৪:৩০: কন্টিনেন্টাল এয়ার লাইন্সের ডিসি ১০-৩০ বিমানটি যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সির নিউওয়ার্ক বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে রানওয়ে ত্যাগ করলো।
বিকেল ৪:৩৫: নির্ধারিত সময়ের এক ঘণ্টা পর এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইট ৪৫৯০ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়ার জন্য রানওয়ে ২৬ আর এর ডিপারচার পয়েন্টে এসে দাঁড়াল। শার্ল দ্যা গল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের প্রধান নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার থেকে কনকর্ডের এই যাত্রাটি নিয়ন্ত্রণ করছেন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার জিল লজলাঁ। লজলাঁ শার্ল দ্যা গল বিমান বন্দরের একজন অভিজ্ঞ এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার। আজ তার দায়িত্ব ছিল সকালের ফ্লাইটগুলো সামলানোর কিন্তু বিকেলের শিফটের কন্ট্রোলার কোন সমস্যার কাড়নে জিল লজলাঁর সাথে শিফট বদলে নিয়েছে। লজলাঁ কনকর্ডের ক্যাপ্টেন মার্টির সাথে কথা বলে ফ্লাইট ৪৫৯০ কে যাত্রা শুরুর নির্দেশ দিলে কনকর্ড বিমানটি রানওয়ে দিয়ে দৌড় শুরু করল। টাওয়ার থেকে কন্ট্রোলার লজলাঁ বিমানটির উপর নজর রাখছিলেন। কনকর্ড চার হাজার মিটার দৈর্ঘ্যের রানওয়ের অর্ধেক পাড়ি দিতেই এর গতিবেগ হল ঘণ্টায় ৩২০ কিলোমিটার। এই গতি অর্জনকে বলা হয়ে থাকে পয়েন্ট অব নো রিটার্ন অর্থাৎ এই গতিতে চলন্ত একটি বিমানের পাইলট শুধু একটি কাজই করতে পারেন আর তা হল বিমানটিকে আকাশে তোলা। কনকর্ডের গতিবেগ ৩২০ কিলোমিটার অতিক্রম করতেই কন্ট্রোলার লজলাঁ লক্ষ্য করলেন বিমানটির ডান পাখার নীচ থেকে ধোঁয়া এবং আগুন বেড়িয়ে আসছে। সাথে সাথে তিনি ক্যাপ্টেন মার্টির সাথে রেডিওতে যোগাযোগ করে আগুনের কথা জানালেন। এই সময় কনকর্ডের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৩২৮ কিলোমিটার। ক্যাপ্টেন মার্টি আগুন দেখতে না পেলেও দুটি ইঞ্জিনের শক্তি হঠাৎ করে কমে যাওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারছিলেন। কিন্তু এ সময় ক্যাপ্টেন মার্টির কিছুই করার ছিল না।
বিকেল ৪:৪৩:১৫: ক্যাপ্টেন মার্টি কন্ট্রোল কলামটি নিজের দিকে টেনে নিতেই কনকর্ড মাথা উঁচু করে আকাশে উঠে গেল। ডান দিকের বিশাল ডানার নীচে তখন প্রচণ্ড আগুন জ্বলছিল এবং পেছনে আগুন ও ধোঁয়ার বিশাল স্তম্ভ নিয়ে বিমানটি উপরে উঠার চেষ্টা করছিল।
বিকেল ৪:৪৩:৩০: মাটি থেকে মাত্র ৯০ মিটার উপরে উঠা বিমানটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ক্যাপ্টেন মার্টি হিমশিম খাচ্ছিলেন। বিমানটি ক্রমশ: বাম দিকে হেলে পরছিল এবং ডান দিকের ইঞ্জিন দুটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ক্যাপ্টেন মার্টি এবং ফার্ষ্ট অফিসার মার্কো বিমানটিকে নিকটবর্তী লে বোর্জ বিমান বন্দরে অবতরণ করানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে আগুনের বিস্তার এত বেশী হয়ে পরেছে যে তাঁদের সব চেষ্টাই বিফলে গেল। হঠাৎ করে ডান দিকের ডানাটি বিমান থেকে খুলে নীচে পরে যায়।
বিকেল ৪:৪৫: ডান দিকের ডানার নীচের ইঞ্জিন দুটো সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যেতেই কনকর্ডের গতি কমতে শুরু করে এবং ডানা খুলে যাওয়ার পর মুহূর্তের মধ্যেই বিমানটি খাড়া হয়ে নীচের দিকে পরে যেতে থাকে। ১০ সেকেন্ডের মধ্যে বিমানটি নীচে অবস্থিত লে রেলিস ব্লিউস নামের একটি হোটেল বিল্ডিং এর উপর পরে বিস্ফোরিত হল।
শার্ল দ্যা গল বিমান বন্দরের টাওয়ার থেকে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার জিল লজলাঁ দুর্ঘটনাটি পুরোপুরি দেখতে পেলেন। কনকর্ডের মত এত নিরাপদ একটি বিমান এভাবে দুর্ঘটনায় পরতে পারে তা কোনভাবেই বিশ্বাস হচ্ছিল না তাঁর। বলতে গেলে সমগ্র টাওয়ারটিই ক’ মিনিটের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।
ফ্রান্স ও গ্রেট ব্রিটেনের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তির আওতায় ফ্রান্সের এরোষ্পেসিয়েল এবং ব্রিটিশ এয়ারক্রাফট কর্পোরেশনের যৌথ উদ্যোগে উৎপাদিত সুপারসনিক ট্রান্সপোর্ট বা এসএসটি কনকর্ড ১৯৬৯ সনে প্রথম আকাশে উড়ে। ১৯৭৬ সনে কনকর্ড বাণিজ্যিক যাত্রী পরিবহন শুরু করে। ১৯৭৬ থেকে ২০০০, এই ২৪ বছরে কনকর্ড এর মাধ্যমে অসংখ্য ফ্লাইট পরিচালিত হয়েছে কিন্তু বড় ধরনের দুর্ঘটনা এই প্রথম ঘটল। দুর্ঘটনার মাধ্যমে কনকর্ড বিমান ধংস হয়ে গেছে, এই সংবাদটি বিশ্বাস করতে অনেকেরেই কষ্ট হয়েছিল। তারপরও বাস্তবতা এই ছিল যে প্যারিসের শার্ল দ্যা গল বিমান বন্দর থেকে উড্ডয়নের দু মিনিটের মধ্যেই এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইট ৪৫৯০ দুর্ঘটনায় পরে এবং ১০৯ জন আরোহী সহ কনকর্ড বিমানটি সম্পূর্ণরূপে ধংস হয়ে যায়। প্যারিসের গিনেজ এলাকায় অবস্থিত যে হোটেলটির উপর কনকর্ড বিধ্বস্ত হয় তার ৪ জন কর্মীও একই সাথে নিহত হন।
কনকর্ড বিধ্বস্ত হওয়ার সাথে সাথে উদ্ধার কর্মীরা ছুটে আসে কিন্তু প্রজ্বলিত ধংসাবশেষে প্রচণ্ড তাপের কাড়নে উদ্ধারকাজ বিলম্বিত হয়। উদ্ধার কাজ শেষ হতে প্রায় ৪৮ ঘণ্টা সময় লাগে এবং উদ্ধার সম্পন্ন হওয়ার পর দেখা যায় প্রচণ্ড তাপে মৃতদেহগুলো এমনভাবে বিকৃত হয়েছে যে বিমানের কোন যাত্রী বা ক্রুদের পৃথকভাবে সনাক্ত করা সম্ভব নয়।
প্যারিসের শার্ল দ্যা গল বিমান বন্দরের কাছে কনকর্ডের দুর্ঘটনার পরবর্তীতে ফ্রান্স কর্তৃপক্ষ কনকর্ডের সবগুলো বিমান পরিচালনা স্থগিত ঘোষণা করে এবং ফ্রান্সের এয়ার এক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো এই দুর্ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব গ্রহণ করে।
দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্য