Thursday, September 12, 2013

এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইট ৪৫৯০: অন্তিম যাত্রায় আকাশের রানী কনকর্ড- শেষ পর্ব

২৫শে জুলাই ২০০০ বিকেল :৫০ মিনিট যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক জন এফ কে বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়ার দশ মিনিটের মধ্যে এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইট ৪৫৯০ পরিচালনায় ব্যবহৃত কনকর্ড বিমানটি ১০৯ জন যাত্রী ক্রু সহ প্যারিসের শার্ল দ্য গল বিমান বন্দরের অদূরে গনেসী নামক স্থানে বিধ্বস্ত হয়েছে শার্ল দ্যা গল বিমান বন্দরের টাওয়ার থেকে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার জিল লজলাঁ দুর্ঘটনাটি প্রথম থেকেই দেখছিলেন দুর্ঘটনাটি ঘটার প্রায় সাথে সাথেই উদ্ধার কর্মীরা দুর্ঘটনাস্থলে হাজির হলেও প্রজ্বলিত আগুনের প্রচণ্ড তাপের কারণে উদ্ধার কাজ আরম্ভ করতে পারে নি ইতোমধ্যে লে রেলিস ব্লিউস নামক হোটেলটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে গেছে এবং হোটেলের চার জন কর্মীর মৃত্যু হয়েছে

কনকর্ড দুর্ঘটনার সংবাদটি খুব দ্রুত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে পরে এবং বাণিজ্যিক বিমান চলাচল দুনিয়ায় মহা বিস্ময়ের সৃষ্টি হয় এই অসম্ভব দুর্ঘটনার তদন্তের জন্য ফ্রান্স সরকার এয়ার এক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরোকে দায়িত্ব প্রদান করে সন্ত্রাসীদের পেতে রাখা বোমার কারণেই এই দুর্ঘটনাটি হয়েছে বলে প্রথমে সন্দেহ করা হয় ধারনা করা হয় যাত্রীদের লাগেজে রাখা কোন ধরনের বিস্ফোরক এই প্রচণ্ড আগুনের জন্য দায়ী এই সন্দেহ প্রমাণের জন্য তদন্তকারীরা দুর্ঘটনাস্থল থেকে বিধ্বস্ত কনকর্ডের সবগুলো অংশ সংগ্রহ করে লে বোর্জ বিমান বন্দরের তিনটি হ্যাঙ্গারে জমা করেন তদন্তকারীরা শার্ল দ্য গল বিমান বন্দরের যে রানওয়ে থেকে কনকর্ড শেষবারের মত উড্ডয়ন করেছিল সেই ২৬ আর রানওয়েটিকেও ভালভাবে পর্যবেক্ষন করতে গিয়ে অনেকগুলো অস্বাভাবিক বস্তু খুঁজে পান যেগুলো কোন অবস্থাতেই রানওয়েতে থাকার কথা নয় এই অস্বাভাবিক প্রকৃতির বস্তুগুলো সংগ্রহ করে বিশ্লেষণের জন্য বিইএ ল্যাবে পাঠানো হয় তদন্তের এই পর্যায়ে সন্ত্রাসীদের পেতে রাখা বোমায় বিমান ধংসের তত্বটি বাতিল হয়ে যায় কারণ ধংসাবশেষ থেকে সংগ্রহ করা বিমানের বিভিন্ন পার্টস পরীক্ষা করে বিস্ফোরনের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি তবে রানওয়ে ২৬ আর থেকে সংগ্রহিত বস্তুগুলো পরীক্ষা করার পর দুটি প্রতি তদন্তকারীদের মনোযোগ আকর্ষিত হয় প্রথমটি একটি রাবারের টুকরো যা ওজনে প্রায় . কেজির মত অপরটি একটি টাইটানিয়ামের তৈরি অ্যালয় স্ট্রিপ যা লম্বায় প্রায় ১৭ ইঞ্চি বিশ্লেষণের মাধ্যমে জানা যায়, রাবারের টুকরোটি কনকর্ড বিমানটির চাকার একটি অংশ এবং ধারালো কোন বস্তুর আঘাতে রাবারের টুকরোটি চাকা থেকে খুলে এসেছে তদন্তকারীরা টাইটানিয়াম অ্যালয় স্ট্রিপ পরীক্ষা করে জানতে পারেন যে এটি ম্যাকডোনাল্ড ডগলাস কোম্পানির তৈরি ডিসি ১০-৩০ বিমান ইঞ্জিনের কভারের একটি অংশ এবং এই স্ট্রিপটি কনকর্ড উড্ডয়নের পাঁচ মিনিট পূর্বে কন্টিনেন্টাল এয়ারলাইন্সের যে বিমানটি ২৬ আর রানওয়ে থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সির উদ্দেশ্যে উড়ে গিয়েছিল, সেই ডিসি ১০-৩০ বিমান ইঞ্জিনের কভার থেকে খুলে রানওয়েতে পরে যায়
দীর্ঘ তদন্ত শেষে ফ্রান্সের এয়ার এক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো ২০০২ এর জানুয়ারি মাসে কনকর্ড দুর্ঘটনার পুর্নাঙ্গ রিপোর্ট প্রকাশ করে তদন্তকারীরা দুর্ঘটনাস্থলে এবং এর আশে পাশে প্রাপ্ত সব ধরনের বর্জ্য চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে কনকর্ড দুর্ঘটনার মূল রহস্যটি ভেদ করেন বিইএ রিপোর্টের সারসংক্ষেপে দুর্ঘটনার বিবরণটি ছিল এরকম:
বিকেল :৩০ মিনিটে কন্টিনেন্টাল এয়ারলাইন্সের ডিসি ১০-৩০ বিমানটি ২৬ আর রানওয়ে থেকে উড্ডয়নের সময় বিমান ইঞ্জিনের কভার থেকে ১৭. ইঞ্চি লম্বা এবং . ইঞ্চি চওড়া টাইটানিয়াম অ্যালয় স্ট্রিপ খুলে রানওয়েতে পরে যায় কনকর্ড উড্ডয়নের পূর্বে তার জন্য নির্ধারিত রানওয়ে ভালভাবে পরীক্ষা করে দেখার যে নিয়ম আছে, সময়াভাবে সে পরীক্ষাটি করা হয় নাই বিধায় স্ট্রিপটি রানওয়েতে পরে থাকে বিকেল :৩৫ মিনিটে কনকর্ড রানওয়ে ২৬ আর এর ডিপারচার পয়েন্ট থেকে যাত্রা শুরু করে সময় কনকর্ডের মোট ওজন তার সর্বোচ্চ ওজন থেকে ৮৩০ কেজি বেশী ছিল এবং ধারনা করা হয় যে কনকর্ডের লাগেজ হোল্ডে যাত্রীদের লাগেজ ওজন অনুযায়ী সঠিকভাবে ভারসাম্য বজায় রেখে সাজানো হয় নি বিধায় চলন্ত অবস্থায় কনকর্ড ধীরে ধীরে রানওয়ের বা দিকে চলে আসে এই সময় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাককে বহনকারী একটি বোয়িং ৭৪৭ বিমানের প্রায় কাছে চলে যায় বোয়িং ৭৪৭ বিমানটি ২৬ আর রানওয়ের নিকটস্থ আরেকটি রানওয়েতে অবতরণ করছিল তদন্তকারীরা লক্ষ্য করেন যে কনকর্ড রানওয়েতে তার সর্বশেষ উড্ডয়ন পয়েন্ট অতিক্রম করার পরেও ভি১ গতিবেগ অর্জনে ব্যর্থ হয় অতিরিক্ত ওজনের কারণে এক পর্যায়ে বিমানটি সর্বশেষ উড্ডয়ন পয়েন্ট থেকে বেশ কিছু দূরে এসে ভি১ গতিবেগ অর্জন করে এবং এই পর্যায়ে কনকর্ডের বা দিকের চাকা রানওয়েতে পরে থাকা টাইটানিয়াম অ্যালয় স্ট্রিপের উপর এসে পরলে ধারালো স্ট্রিপের আঘাতে চাকা থেকে প্রায় . কিলোগ্রাম ওজনের একটি টুকরো কেটে বেড়িয়ে এসে ডান দিকের ডানার নীচে আঘাত করে সময় বিমানের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ৩১০ কিলোমিটার রাবারের টুকরোটি প্রচণ্ড গতিতে ডানার নীচে আঘাত করায় একটি শক ওয়েভের সৃষ্টি হলে নং ফুয়েল ট্যাংকের সবচাইতে দুর্বল জায়গাটি ছিদ্র হয়ে জেট ফুয়েল বেড়িয়ে আসতে থাকে একই সময় রাবারের টুকরোটির আঘাতে বিমানের চাকার সাথে জড়িয়ে থাকা বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে গেলে সেখানে স্পার্ক সৃষ্টি হয়ে আগুন ধরে যায়
এমন একটি সময় এই ঘটনাটি ঘটে যখন বিমানের গতি ছিল ভি১ অর্থাৎ এই গতিবেগে বিমানের পাইলটদের একটিই করনীয় থাকে আর তা হল রানওয়ে ত্যাগ করা পাঁচ নং ফুয়েল ট্যাংকের ছিদ্র দিয়ে তেল বেড়িয়ে যেতে থাকায় নং ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে আবার চালু হয় কিন্তু আগুন ধরে যাওয়ার পর ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার নং ইঞ্জিনটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন ফলে আকাশে উপরের দিকে উঠে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির অভাবে বিমানটির গতি ধীরে ধীরে কমতে থাকে অপর দিকে বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে যাওয়ায় বিমানের চাকাগুলো হোল্ডে নেয়া সম্ভব হয় না ফলে চাকাগুলোর ওজন বিমানটিকে নীচের দিকে টানতে থাকেমাটি থেকে মাত্র ২০০ ফিট উচ্চতায় যাওয়ার পর বিমানটির উপরে উঠা বন্ধ হয়ে যায়, ডানদিকে ডানা ভেঙ্গে পরে এবং বিমানটি বাম দিকে ১০০ ডিগ্রী হেলে পরে গনেসীস্থ হোটেল লে রিলেইস ব্লিউ এর উপর পরে যায়

এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইট ৪৫৯০ দুর্ঘটনার পর ফ্রান্স সরকারের নির্দেশে কনকর্ডকে ফ্লাইট পরিচালনার অনুপযুক্ত ঘোষণা করা হয় এখন পর্যন্ত কনকর্ড বিমান ব্যবহার করে বাণিজ্যিক ফ্লাইট পরিচালনা সারা বিশ্বেই নিষিদ্ধ রয়েছে তবে চেষ্টা চলছে যাতে বিমানটিকে আরও নিরাপদ করে পুনরায় যাত্রী পরিবহনের লাগানো যায় হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আকাশের রাণী কনকর্ড আবারো বিশ্বের বিভিন্ন বিমান বন্দরে যাত্রী পরিবহন শুরু করবে, কনকর্ড প্রেমী বিশ্বের অসংখ্য মানুষ এই আশাবাদ নিয়েই কনকর্ডের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার জন্য কাজ করছেন