এখন গ্রীনিচ মাণ সময় সকাল আটটা। সম্রাট কনিস্কের মূল পরিচালক ক্যাপ্টেন হনস সিং নরেন্দ বিমানটি নিয়ন্ত্রন করছেন। তাঁকে সহযোগীতা করছেন কো-পাইলট সতিন্দর সিং ভিন্দার এবং ফ্লাইট ইন্জিনিয়ার দারা দুমাসিয়া। সতিন্দর সিং ভিন্দার নিজেও একজন ক্যাপ্টেন তবে এই ফ্লাইটে তিনি সহকারীর দায়ীত্ব পালন করছেন। বোয়িং ৭৪৭ একটি আধুনিক বিমান। উড়ন্ত অবস্থায় বিমানটির ক্যাপ্টেনের তেমন কিছু করার থাকে না। এ সময় কো-পাইলট বা ফার্ষ্ট অফিসারই মূলত: ব্যাস্ত থাকে মাটিতে অবস্থিত এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল কেন্দ্রের সাথে রেডিও যোগাযোগ নিয়ে। সম্রাট কনিস্কের সাথে এই মূহুর্তে আয়ারল্যান্ডের শ্যানন বিমান বন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল কেন্দ্রের রেডিও যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। কো-পাইলট সতিন্দর সিং ভিন্দার শ্যানন কন্ট্রোলের কাছে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা অব্যাহত রাখার অনুমতি চাইলেন। শ্যানন কন্ট্রোলে দুজন কন্ট্রোলার কাজ করছেন। টমাস নেইল এবং মাইকেল কেইন তাঁদের কাজ ভাগ করে নিয়েছেন। এই মুহুর্তে দুজনে মাত্র তিনটি ফ্লাইট নিয়ে কাজ করছেন। ফ্লাইট সমুহ পরিচালনাকারী বিমান তিনটি একই লেভেলে তিনটি ভিন্ন উচ্চতায় থেকে লন্ডনের উদ্দেশ্যে চলছে। ৩৭০০০ ফিট উচ্চতায় রয়েছে কানাডা প্যাসিফিক ফ্লাইট সিপি ২৮২, ৩৫০০০ ফিট উচ্চতায় টিডব্লিউএ ফ্লাইট ৭৭০ এবং ৩১০০০ ফিট উচ্চতায় এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট ১৮২ ।
এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটটি নিয়ন্ত্রন করছেন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার মাইকেল কেইন। আকাশে উড়ন্ত বিমানগুলো পর্যবেক্ষনের জন্য তিনি একটি টু-ডায়মেনশনাল রাডার ব্যবহার করছেন ফলে রাডার মনিটরে একই লেভেলে উড়ন্ত তিনিটি বিমান একটি অন্যটির উপর অবস্থান করছে বলে মনে হচ্ছে। কন্ট্রোলার মাইকেল কেইন ফ্লাইট ১৮২ এর কো-পাইলট ক্যাপ্টেন সতিন্দর সিং ভিন্দার এর সাথে রেডিওতে কথা বললেন:
ক্যাপ্টেন ভিন্দার: শুভ সকাল শ্যানন কন্ট্রোল। এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট ১৮২ থেকে বলছি।
মাইকেল কেইন: শুভ সকাল ফ্লাইট ১৮২, তোমার অবস্থান জানাও।
ক্যাপ্টেন ভিন্দার: ৫০ ডিগ্রী দক্ষিন এবং ১৫ ডিগ্রী পশ্চিম, ফ্লাইট লেভেল ৩১০০০ হাজার ফিট।
মাইকেল কেইন: ফ্লাইট ১৮২, লেভেল ৩১০০০ ফিটে রেখে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা অব্যাহত রাখার অনুমতি দেয়া হল।
ক্যাপ্টেন ভিন্দার: ধন্যবাদ শ্যানন কন্ট্রোল, ফ্লাইট লেভেল ৩১০ রেখে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা অব্যাহত রাখছি।
এটাই ছিল ফ্লাইট ১৮২ এর সাথে শ্যানন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সর্বশেষ কথোপোকথন।
সকাল ৮:১৪ মিনিট। মাইকেল কেইন তাঁর সম্মুখস্থ টু-ডায়মেনশনাল রাডার মনিটরে তাকিয়ে একটি অভূতপূর্ব দৃশ্য লক্ষ্য করলেন। বিভিন্ন উচ্চতায় উড়ন্ত বিমানগুলোর সংকেত সমূহ একই লেভেলে এসে একটি আরেকটির উপর প্রতিস্থাপিত হওয়ায় মনে হচ্ছিল আকাশে এই মুহুর্তে একটি মাত্র বিমান উড়ছে। মাইকেল কেইন তাঁর ট্র্যাকিং ডিভাইস ব্যবহার করে ফ্লাইট সমূহ পৃথক করার কাজ শুরু করলে পয়তাল্লিশ সেকেন্ড পরে টিডব্লিউএ এবং কানাডা প্যাসিফিক ফ্লাইট দুইটি পুনরায় রাডারে আলাদা ভাবে দেখা গেলেও এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট ১৮২ এর কোন চিন্হ পাওয়া গেল না। মাইকেল কেইন এবং টমাস নেইল দুজনে আবার চেষ্টা করলেন কিন্তু কোন ভাবেই সম্রাট কনিস্কের ফ্লাইট সংকেতটি রাডারের পর্দায় দেখা গেল না। তাঁরা দুজনে পৃথকভাবে ফ্লাইট ১৮২ এর সাথে রেডিও যোগাযোগের চেষ্টা করলেন কিন্তু মনে হল পেছনে কোন চিন্হ না রেখেই সম্রাট কনিষ্ক বাতাসে মিলিয়ে গেছে।
সম্রাট কনিস্কের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ষাট সেকেন্ডের মধ্যে শ্যানন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল থেকে এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট ১৮২ হাড়িয়ে যাওয়ার সংবাদটি ঘোষনা করা হল। এ সময় আয়ারল্যান্ডের রাজধানী কর্ক থেকে ২৯০ কিলোমিটার দক্ষিন পশ্চিমে ৩১০০০ ফিট উপরে বিমানটি অবস্থান করছিল। শ্যানন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল সম্রাট কনিস্কের হাড়িয়ে যাওয়ার ঘোষনা দেয়ার সাথে সাথে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে অবস্থানরত বেশ কটি জাহাজ বিমানটি খুঁজতে থাকে। ঠিক দু ঘন্টা পর লরেনশিয়ান ফরেষ্ট নামের একটি কানাডিয়ান মালবাহী জাহাজ সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় সম্রাট কনিষ্কের ধংসাবশেষ খুঁজে পায়। কিছুক্ষনের মধ্যেই প্রমানিত হয় যে কোন প্রকার আভাষ ইঙ্গীত ব্যাতীতই সম্রাট কনিষ্ক দুর্ঘটনায় পরে ধংস হয়ে গেছে। এমনকি, একেবারে নিখুঁতভাবে চলমান বিমানটি শেষ মুহুর্তেও কোনপ্রকার সমস্যার কথা জানায় নি। পরবর্তীতে জানা যায় বিমানের ক্যাপ্টেন ও কো-পাইলট বিমানটিতে বহন করা কিছু মালামালের কাষ্টমস ক্লিয়ারেন্স এর বিষয়ে কথা বলতে বলতেই এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
কিছুক্ষনে মধ্যেই বিমানের ধংসাবশেষের সাথে সমূদ্রে ভাসমান মৃতদেহগুলো আইরিশ নৌবাহিনীর জাহাজে করে কর্কে নিয়ে আসা হয়। ইতোমধ্যেই নিশ্চিত হওয়া গেছে যে সম্রাট কনিস্কের যাত্রী এবং ক্রুদের মধ্যে সবাই দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। দূর্ঘটনার সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পরতেই ভারতের এয়ার এক্সিডেন্ট ইনভেষ্টিগেশন ব্যুরোর বিমান দূর্ঘটনা তদন্তকারী দল আয়ারল্যান্ডে উপস্থিত হল। ভারতীয় তদন্তকারী দলের প্রধান এইচ এস খোলা আইরিশ তদন্ত দলের সাথে যোগ দেন। ইতোমধ্যে আটলান্টিক মহাসাগরে ভাসমাণ অবস্থায় মোট ১৩২টি মৃতদেহ উদ্ধার করে কর্কে নিয়ে আসা হয়েছে। কর্ক সিটি হসপিটালের প্রধান প্যাথোলজিষ্ট ড: কিউমিন ডয়েল এর উপর উদ্ধারকৃত মৃতদেহগুলো অটপ্সি বা পরীক্ষা করার দায়ীত্ব পরলো এবং তিনি প্রথম মৃতদেহটি হাসপাতালে পৌছার সাথে সাথেই অটপ্সি শুরু করলেন। অটপ্সি করার উদ্দেশ্য ছিল বিমান দূর্ঘটনার মূল কারনটি সম্বন্ধে জানা। পরবর্তী চার দিনে মোট ১৩২টি মৃতদেহ পরীক্ষা করা হলে একটি বিষ্ময়কর ফলাফল বেড়িয়ে আসে। ড: ডয়েল জানালেন অধীকাংশ যাত্রীদের মৃত্যু হয়েছে আকাশে থাকা অবস্থায় অর্থাৎ বিমান উড়ন্ত অবস্থায় এমন কিছু ঘটেছিল যার কারনে যাত্রীদের হঠাৎ মৃত্যু হয়। তিনি পরীক্ষা করে জানতে পারেন যে বেশীর ভাগ যাত্রীদের পড়নের কাপড় ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল যা প্রমান করে যে মৃত্যুর সময় তারা সবাই প্রায় ৩০০০০ ফিট উপরে বিমান থেকে ছিটকে বেড়িয়ে গিয়েছিলেন। অটপ্সিতে আরও দেখা যায় অধীকাংশ যাত্রীদের দেহের বিভিন্ন অংশের হাড় হয় ভেঙ্গে গেছে অথবা জোড়া খুলে গেছে।
ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও ভারতের তদন্তকারীরা এই পর্যায়ে নিশ্চিত হলেন যে বিমানটি আকাশে ৩১০০০ ফিট উপরে থাকতেই দূর্ঘটনার কবলে পরে এবং হঠাৎ করেই বিস্ফোরিত হয় ফলে যাত্রী এবং ক্রুদের সবাই মৃত্যু বরণ করেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আকাশের ৩১০০০ ফিট উপরে এমন কি ঘটেছিল যে বিমানটি বিষ্ফোরিত হল? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য আন্তর্জাতিক বিমান দূর্ঘটনা তদন্তকারী দল তাঁদের সর্বশক্তি নিয়ে তদন্ত শুরু করলেন।
দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্য