২২শে মে ২০২০, সকাল ১১:০০টা। পাকিস্তানের লাহোরে অবস্থিত আল্লামা ইকবাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। বোর্ডিং গেটে পিআইএ (পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স) ‘র একটি এয়ারবাস ৩২০ বিমান উড়ানের জন্য তৈরী হচ্ছে। এটি একটি বিশেষ ফ্লাইট। করোনা ভাইরাস প্যানডেমিকের কারনে এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই সব ধরনের ডোমেষ্টিক ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চলাচল বন্ধ আছে। তবে তিন দিন পরে মুসলিমদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর অনুষ্ঠিত হবে বিধায় আটকে পরা মানুষদের আত্নীয় স্বজনদের কাছে পৌছে দেয়ার লক্ষ্যে পাকিস্তান সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ সীমিত কিছু ফ্লাইট পরিচালনার অনমতি দিয়েছে। পিআইএ ৮৩০৩ এ ধরনের বিশেষ অনুমতি প্রাপ্ত একটি ফ্লাইট যেটি লাহোর আল্লামা ইকবাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে করাচীর জিন্নাহ আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর যাবে। এই ফ্লাইটের মোট উড়ান সময় ৯০ মিনিট। আজকের ফ্লাইটে মোট যাত্রী সংখ্যা ৯১ এবং ক্রু সংখ্যা ৮ জন। দুজন ককপিট আর ৬ জন কেবিন ক্রু। প্লেনের মূল পাইলট হলেন ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ গুল এবং ফার্ষ্ট অফিসার উসমান আজম।
দুপুর ১২:০০টা- মেইনট্যানেন্স ক্রুরা বিমান থেকে নেমে গেলে ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ গুল বোর্ডিং শুরু করার অনমতি দিলেন। ক্যাপ্টেন গুল একজন অভিজ্ঞ পাইলট প্রায় ২৪ বছর ধরে বিমান চালাচ্ছেন। এয়ারবাস এ ৩২০ বিমান চালনায় তার ৪৭০০ ঘন্টার অভিজ্ঞতা রয়েছে। ফার্ষ্ট াফিসার উসমান আজম একজন নবীন পাইলট।
দুপুর ১২:৪৫ মি:- এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারের অনুমতি পেয়ে ক্যাপ্টেন গুল বিমানটিকে বোর্ডিং
এরিয়া থেকে ট্যাক্সিওয়ে ধরে রানওয়েতে নিয়ে এলেন। ঠিক দুপুর ১:০৫ টায় বিমানটি আকাশে উঠে এল। বিমানটি এয়ারবাস ৩২০-২১৪ সিরিজের এবং ২০০৪ সনে ফ্রান্সে এয়ারবাস ফ্যাক্টরীতে তৈরী হয়ে প্রথমে চায়না ইষ্টার্ন এয়ারলাইন্সে যাত্রী পরিবহন শুরু করে। ২০১৪ সনে বিমানটি পিআইএ লীজ নেয়। অত্যন্ত আধুনিক এই বিমানটিতে দুটি সিএফম ইন্জিন ব্যবহার করা হয়েছে।
দশ হাজার ফিট উঠে যাওয়ার পর ক্যাপ্টেন অটো পাইলট চালু করলেন। এখান থেকে বিমানটি ধীরে ধীরে ২৯ হাজার ফিট উচ্চতায় উঠে ঘন্টায় চারশ কিমি বেগে করাচীর দিকে উড়ে যাবে এবং শেষ ওয়েপয়েন্ট মাকলিতে পৌছার আগে ক্যাপ্টেন বিমানের নিয়ন্ত্রন নিয়ে উচ্চতা ও স্পীড কমাতে থাকবেন যাতে মাকলি পৌছার পর বিমানের উচ্চতা হয় ৭০০০ ফিট এবং স্পীড হবে ২৬০ কিমি প্রতি ঘন্টা। বিমানটিকে অটো পাইলটের নিয়ন্ত্রনে ছেড়ে দিয়ে পাইলট দুজন কোভিড ১৯ সংক্রমন নিয়ে কথা বলা শুরু করলেন। দুজনেই এই ভয়ংকর রোগটি নিয়ে দু:শ্চিন্তাগ্রস্ত। ক্যাপ্টেন বলছিলেন, ফার্ষ্ট অফিসার শুনছিলেন। হঠাৎ ফার্ষ্ট অফিসার সাজ্জাদ আযম লক্ষ্য করলেন যে তাদের বিমান ইতোমধ্যেই মাকলি ওয়েপয়েন্ট অতিক্রম করেছে আর তাদের বিমানের উচ্চতা দশ হাজার ফিট। সে ক্যাপ্টেনের দৃষ্টি আকর্ষন করার সাথে সাথে করাচী এটিসি থেকে নির্দেশ এল “তোমরা নির্ধারিত উচ্চতার চাইতে অনেক উপরে আছ আর স্পীড অনেক বেশী”। বিমানটি এ মুহুর্তে আছে করাচী বিমানবন্দর থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে। এটিসি বিমানের গতি ও উচ্চতা দেখে পাইলটকে হোল্ডিং ডিসেন্ট করার জন্য নির্দেশ দিল। অর্থাৎ বিমানটিকে সরাসরি রানওয়ের দিকে না এনা কিছুটা বেশী দুরুত্বে ধীরে ধীরে নেমে আসার নির্দেশ দিল। নির্দেশের জবাবে ক্যাপ্টেন গুল জানালেন যে তিনি তার বিমানের বর্তমান নেমে আসার প্রোফাইলে সন্তুষ্ট এবং তার কোন অসুবিধা হচ্ছে না। বিমানটি করাচীর ১৯ কিলোমিটারে আসতেই এটিসি জানালো যে বিমানটি উচ্চতা রয়েছে ৭০০০ ফিট। এটিসি বিমানটি হোল্ডিং প্যাটার্নে থেকে উচ্চতা ৩০০০ ফিটে নামিয়ে আনতে বললে ক্যাপ্টেন গুল পুনরায় বললেন যে তিনি তার বিমানের নেমে আসার প্রোফাইলে সন্তুষ্ঠ। তিনি একই ভাবে বিমানটিকে নামিয়ে আসতে থাকলেন ফলে ১০০০ ফিটে অবস্থিত আইএলএস গ্লাইড পাথটি তিনি মিস করলেন অর্থাৎ যে ইলেকট্রনিক বিকন বিমানগুলোকে ধাপে ধাপে নামিয়ে আনে সেই গ্লাইড পাথটি উচ্চতা অনেক বেশী থাকায় তিনি খুঁজে পেলেন না। ক্যাপ্টেন বিমানের উচ্চতা কমানোর জন্য নোজ ডাইভ দিলেন এবং ফাষ্ট অফিসার চাকা নামানোর জন্য হাতলটা টানলেন। এয়ারবাস বিমানগুলোর একটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা হচ্ছে গতি ২৬০ কিমি’র বেশী হলে হাতল টানরেও চাকা নামবে না এবং গিয়ার ফেউলিউর ওয়ার্নিং বাজা শুরু করবে। সুতরাং বিমানটি নোজ ডাইভ দিয়ে উচ্চতা কমিয়ে রানওয়েতে নামতে নামতে প্রায় ৪৫০০ ফিট পার হয়ে গেল এবং চাকা না থাকায় বিমানটি ইন্জিন দুটির উপর ভর করে রানওয়ে স্পর্শ করলো। ইন্জিন কভারের সাথে রানওয়ের সংঘর্ষে আগুনের স্ফুলিংগ তৈরী করে বিমানটি রানওয়ের তিনটি জায়গায় ধাক্কা মেরে পুনরায় আকাশে উঠে গেল। এ সময় ইন্জিন দুটোতে আগুন ধরে যায়। তারপরও বিমানটি প্রায় ১০০০ ফিট উঠে যাওয়ার পর ইন্জিন দুটো পুনরায় বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় ফাষ্ট অফিসার এটিসিকে জানায় যে বিমানের ইন্জিন দুটো বন্ধ হয়ে গেছে। ফার্ষ্ট অফিসার আযম মে ডে বিপদ সংকেত দেয়ার পর পরই বিমানটি ঘুরে আবার রানওয়ের দিকে রওয়ানা দেয় কিন্তু রানওয়ে থেকে ১.৩ কিমি দূরে মডেল কলোনী নামক একটি আবাসিক এলাকায় ক্র্যাশ করে। মোট ৯৯ জনের মধ্যে ৯৭ জনেরই তাৎক্ষনিক মৃত্যু ঘটে।
*২৪শে জুন ২০২০ তারিখে পাকিস্তান এয়ারক্রাফ্ট এক্সিডেন্ট ইনভেষ্টিগেশন বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত প্রাইমারি রিপোর্ট অনুসারে।