Tuesday, July 7, 2020

পিআইএ করাচী প্লেন ক্র্যাশ



২২শে মে ২০২০, সকাল ১১:০০টা। পাকিস্তানের লাহোরে অবস্থিত আল্লামা ইকবাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। বোর্ডিং গেটে পিআইএ (পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স) ‘র একটি এয়ারবাস ৩২০ বিমান উড়ানের জন্য তৈরী হচ্ছে। এটি একটি বিশেষ ফ্লাইট।  করোনা ভাইরাস প্যানডেমিকের কারনে এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই সব ধরনের ডোমেষ্টিক ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট  চলাচল বন্ধ আছে। তবে তিন দিন পরে মুসলিমদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর অনুষ্ঠিত হবে বিধায় আটকে পরা মানুষদের আত্নীয় স্বজনদের কাছে পৌছে দেয়ার লক্ষ্যে পাকিস্তান সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ সীমিত কিছু ফ্লাইট পরিচালনার অনমতি দিয়েছে।  পিআইএ ৮৩০৩ এ ধরনের বিশেষ অনুমতি প্রাপ্ত একটি ফ্লাইট যেটি লাহোর আল্লামা ইকবাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে করাচীর জিন্নাহ আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর যাবে। এই ফ্লাইটের মোট উড়ান সময় ৯০ মিনিট।  আজকের ফ্লাইটে মোট যাত্রী সংখ্যা ৯১ এবং ক্রু সংখ্যা ৮ জন। দুজন ককপিট আর ৬ জন কেবিন ক্রু।  প্লেনের মূল পাইলট হলেন ক্যাপ্টেন  সাজ্জাদ গুল এবং ফার্ষ্ট অফিসার  উসমান আজম।

দুপুর ১২:০০টা- মেইনট্যানেন্স ক্রুরা বিমান থেকে নেমে গেলে ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ গুল বোর্ডিং শুরু করার অনমতি দিলেন। ক্যাপ্টেন গুল একজন অভিজ্ঞ পাইলট প্রায় ২৪ বছর ধরে বিমান চালাচ্ছেন। এয়ারবাস এ ৩২০ বিমান চালনায় তার ৪৭০০ ঘন্টার অভিজ্ঞতা রয়েছে। ফার্ষ্ট াফিসার উসমান আজম  একজন নবীন পাইলট।

দুপুর ১২:৪৫ মি:- এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারের অনুমতি পেয়ে ক্যাপ্টেন গুল বিমানটিকে বোর্ডিং
এরিয়া থেকে ট্যাক্সিওয়ে ধরে রানওয়েতে নিয়ে এলেন। ঠিক দুপুর ১:০৫ টায় বিমানটি আকাশে উঠে এল।  বিমানটি এয়ারবাস ৩২০-২১৪ সিরিজের এবং ২০০৪ সনে ফ্রান্সে এয়ারবাস ফ্যাক্টরীতে তৈরী হয়ে প্রথমে  চায়না ইষ্টার্ন এয়ারলাইন্সে যাত্রী পরিবহন শুরু করে। ২০১৪ সনে বিমানটি পিআইএ লীজ নেয়। অত্যন্ত আধুনিক এই বিমানটিতে দুটি সিএফম ইন্জিন ব্যবহার করা হয়েছে।

 দশ হাজার ফিট উঠে যাওয়ার পর ক্যাপ্টেন অটো পাইলট চালু করলেন। এখান থেকে বিমানটি ধীরে ধীরে ২৯ হাজার ফিট উচ্চতায় উঠে ঘন্টায় চারশ কিমি বেগে করাচীর দিকে উড়ে যাবে এবং শেষ ওয়েপয়েন্ট  মাকলিতে পৌছার আগে ক্যাপ্টেন বিমানের নিয়ন্ত্রন নিয়ে উচ্চতা ও স্পীড কমাতে থাকবেন যাতে মাকলি পৌছার পর বিমানের উচ্চতা হয় ৭০০০ ফিট এবং স্পীড হবে ২৬০ কিমি প্রতি ঘন্টা। বিমানটিকে অটো পাইলটের নিয়ন্ত্রনে ছেড়ে দিয়ে পাইলট দুজন কোভিড ১৯ সংক্রমন নিয়ে কথা বলা শুরু করলেন। দুজনেই এই ভয়ংকর রোগটি নিয়ে দু:শ্চিন্তাগ্রস্ত। ক্যাপ্টেন বলছিলেন, ফার্ষ্ট অফিসার শুনছিলেন। হঠাৎ ফার্ষ্ট অফিসার সাজ্জাদ আযম লক্ষ্য করলেন যে তাদের বিমান ইতোমধ্যেই মাকলি ওয়েপয়েন্ট অতিক্রম করেছে আর তাদের বিমানের উচ্চতা দশ হাজার ফিট। সে ক্যাপ্টেনের দৃষ্টি আকর্ষন করার সাথে সাথে করাচী এটিসি থেকে নির্দেশ এল “তোমরা নির্ধারিত উচ্চতার চাইতে অনেক উপরে আছ আর স্পীড অনেক বেশী”। বিমানটি এ মুহুর্তে আছে করাচী বিমানবন্দর থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে। এটিসি বিমানের গতি ও উচ্চতা দেখে পাইলটকে হোল্ডিং ডিসেন্ট করার জন্য নির্দেশ দিল। অর্থাৎ বিমানটিকে সরাসরি রানওয়ের দিকে না এনা কিছুটা বেশী দুরুত্বে ধীরে ধীরে নেমে আসার নির্দেশ দিল। নির্দেশের জবাবে ক্যাপ্টেন গুল জানালেন যে তিনি তার বিমানের বর্তমান নেমে আসার প্রোফাইলে সন্তুষ্ট এবং তার কোন অসুবিধা হচ্ছে না। বিমানটি করাচীর ১৯ কিলোমিটারে আসতেই এটিসি জানালো যে বিমানটি উচ্চতা রয়েছে ৭০০০ ফিট। এটিসি বিমানটি হোল্ডিং প্যাটার্নে থেকে উচ্চতা ৩০০০ ফিটে নামিয়ে আনতে বললে ক্যাপ্টেন গুল পুনরায় বললেন যে তিনি তার বিমানের নেমে আসার প্রোফাইলে সন্তুষ্ঠ। তিনি একই ভাবে বিমানটিকে নামিয়ে আসতে থাকলেন ফলে ১০০০ ফিটে অবস্থিত আইএলএস গ্লাইড পাথটি তিনি মিস করলেন অর্থাৎ যে ইলেকট্রনিক বিকন বিমানগুলোকে ধাপে ধাপে নামিয়ে আনে  সেই গ্লাইড পাথটি উচ্চতা অনেক বেশী থাকায়  তিনি খুঁজে পেলেন না। ক্যাপ্টেন বিমানের উচ্চতা কমানোর জন্য নোজ ডাইভ দিলেন এবং ফাষ্ট অফিসার চাকা নামানোর জন্য হাতলটা টানলেন। এয়ারবাস বিমানগুলোর একটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা হচ্ছে গতি ২৬০ কিমি’র বেশী হলে হাতল টানরেও চাকা নামবে না এবং গিয়ার ফেউলিউর  ওয়ার্নিং বাজা শুরু করবে। সুতরাং বিমানটি নোজ ডাইভ দিয়ে উচ্চতা কমিয়ে রানওয়েতে নামতে নামতে প্রায় ৪৫০০ ফিট পার হয়ে গেল এবং চাকা না থাকায় বিমানটি ইন্জিন দুটির উপর ভর করে রানওয়ে স্পর্শ করলো। ইন্জিন কভারের সাথে রানওয়ের সংঘর্ষে আগুনের স্ফুলিংগ তৈরী করে বিমানটি রানওয়ের তিনটি জায়গায় ধাক্কা মেরে পুনরায় আকাশে উঠে গেল। এ সময় ইন্জিন দুটোতে আগুন ধরে যায়। তারপরও বিমানটি প্রায় ১০০০ ফিট উঠে যাওয়ার পর ইন্জিন দুটো পুনরায় বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় ফাষ্ট অফিসার এটিসিকে জানায় যে বিমানের ইন্জিন দুটো বন্ধ হয়ে গেছে।  ফার্ষ্ট  অফিসার আযম মে ডে বিপদ সংকেত দেয়ার পর পরই বিমানটি ঘুরে আবার রানওয়ের দিকে রওয়ানা দেয় কিন্তু রানওয়ে থেকে ১.৩ কিমি দূরে মডেল কলোনী নামক একটি আবাসিক এলাকায় ক্র্যাশ করে। মোট ৯৯ জনের মধ্যে ৯৭ জনেরই তাৎক্ষনিক মৃত্যু ঘটে।

*২৪শে জুন ২০২০ তারিখে পাকিস্তান এয়ারক্রাফ্ট এক্সিডেন্ট  ইনভেষ্টিগেশন বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত প্রাইমারি রিপোর্ট অনুসারে।

Sunday, January 15, 2017



হাডসনে মির‌্যাকল

১৫ই জানুয়ারী ২০০৯, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র। বিকেল ৩টা বেজে ২০ মিনিট। ইউএস এয়াওয়েজের ফ্লাইট ১৫৪৯ (ক্যাকটাস ১৫৪৯) নিউইয়র্কের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিমান বন্দর লা-গার্ডিয়ার চার নম্বর রানওয়েতে ডিপারচার নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছে।  এই ফ্লাইটটিতে ব্যবহৃত হবে এয়াবাস ৩২০-২১৪ সিরিজের একটি বিমান। ইউরোপের বিমান নির্মাতা এয়ারবাস ইন্ডাষ্ট্রিজের তৈরী এয়ারবাস ৩২০ সিরিজের বিমানগুলো মধ্যম পাল্লার ফ্লাইটের জন্য অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য এবং পরিচালনা ব্যয় অপেক্ষাকৃত কমের কারনে এয়ালাইন্স সমূহের জন্য লাভজনক বিবেচিত হওয়ায় ইউএস এয়ারওয়েজ মোট ৭৪টি এ-৩২০ বিমান যাত্রী পরিবহনে ব্যবহার করে। ক্যকটাস ১৫৪৯ ফ্লাইটটিতে ব্যবহৃত বিমানটি ১৯৯৯ সনে তৈরী হয়ে ইউএস এয়ারওয়েজের বিমান বহরে যুক্ত হয়েছে এবং দশ বছরে মোট ১৬২৯৯টি ফ্লাইট পরিচালনার মাধ্যমে মোট ২৫২৪১ ফ্লাইট ঘন্টা উড্ডয়ন করেছে। আজকের ফ্লাইটি নিউইয়র্কের লা-গার্ডিয়া বিমান বন্দর থেকে উড্ডয়ন করে ওয়াশিংটন রাজ্যের রাজধানী সিয়েটলের টাকোমা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে উড়ে যাবে। তবে মাঝখানে নর্থ ক্যারোলাইনার শার্লট ডগলাস বিমান বন্দরে কিছুক্ষনের জন্য যাত্রা বিরতী করবে। বিমানটিতে মোট যাত্রী রয়েছেন ১৫০ জন, বিমানটি পরিচালনা করবেন দুজন ক্রু। ফ্লাইট কমান্ডার ক্যাপ্টেন চেলসি বি “সালি” সালেনবার্গার একজন অভিজ্ঞ বিমান চালক যার মোট ১৯৬৬৩ ঘন্টা উড্ডয়ন অভিজ্ঞতা রয়েছে। এয়ারবাস এ ৩২০ পরিচালনায় তার রয়েছে ৪৭৬৫ ঘন্টার অভিজ্ঞতা। তরুন বয়সে তিনি যুক্তরাষ্ট্র বিমান বাহিনীতে এফ-১৬ ফাইটার বিমানের পাইলট ছিলেন। গ্লাইডার পাইলট হিসেবেও তার সুখ্যাতি রয়েছে। আজকের ফ্লাইট পরিচালনায় সালিকে সহায়তা করবেন ফার্ষ্ট অফিসার জেফ্রী বি স্কাইলস। জেফ্রীও একজন অভিজ্ঞ পাইলট এবং ১৫৬৪৩ ফ্লাইট ঘন্টার অধিকারী। তবে আজকের ফ্লাইটটিই তার প্রথম এ ৩২০ ফ্লাইট। এই ফ্লাইটে যাত্রীদের সেবা প্রদানের জন্য মোট তিনজন ষ্টুয়ার্ডেস রয়েছেন যাদের নের্তৃত্বে রয়েছেন ডোনা ডেন্ট।

বিকেল ৩টা বেজে ২৪ মিনিটে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল ফ্লাইট ১৫৪৯কে চার নং রানওয়ের উত্তর পূর্ব  দিক থেকে উড্ডয়নের অনুমতি প্রদান করলে এক মিনিটের মধ্যেই ফার্ষ্ট অফিসার জেফ্রীর নিয়ন্ত্রনে বিমানটি শার্লটের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। বিমানটি সাতশ ফুট উপরে উঠার পর কমান্ডার স্যালি এটিসিকে বিমানের অবস্থান জানালেন। বিকেল ৩টা বেজে ২৭ মিনিট ১১ সেকেন্ড, আড়োহনের এই পর্যায়ে বিমানটি রয়েছে মাটি থেকে ২৮১৮ ফিট উপরে। ঠিক এই সময়েই কানাডিয়ান গীজ নামক এক ঝাক হাঁস জাতীয় পাখীর সাথে বিমানটির সংঘর্ষ হল। বিমানের পাইলট দ্বয় এবং অনেক যাত্রী এই সংঘর্ষের শব্দ পেলেন। সংঘর্ষের সাথে সাথেই বিমানটির উভয় ইন্জিনে আগুন ধরে যায় এবং প্রায় একই সাথে ইন্জিন দুটো বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় বিমানটি নিউইয়র্ক শহরে হাডসন নদীর উপরে নির্মিত জর্জ ওয়াশিংটন ব্রীজের উত্তর পূর্ব কোনে অবস্থান করছিল। উড্ডয়নের পর মাত্র ২ মিনিট ৭ সেকেন্ড কেটেছে, এর মধ্যে বিমানের প্রাণ শক্তির উৎস ইন্জিনগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ায় উড্ডয়ন ধীর হয়ে পরে এবং বিমানটি আরও ১৯ সেকেন্ড ধরে ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠতে থাকে। ইন্জিন বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে কমান্ডার স্যালি বিমানের নিয়ন্ত্রন গ্রহন করে ফার্ষ্ট অফিসার জেফ্রীকে ইন্জিনগুলো চালু করার জন্য চেষ্টা করতে বলেন। জেফ্রী এয়াবাস এ ৩২০ ম্যানুয়েল অনুসরন করে নষ্ট হওয়া ইন্জিন চালু করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।  বিকেল ৩টা বেজে ২৭ মিনিট ৩৬ সেকেন্ডে ক্যাপ্টেন স্যালি নিউইয়র্ক টার্মিনাল এপ্রোচ কন্ট্রোলকে পাখীর সাথে সংঘর্ষ ও বিমানের ইন্জিন বন্ধ হয়ে যাওয়ার সংবাদ দিলে ট্রাকন থেকে তাঁকে বিমান বন্দরে ফিরে আসার নির্দেশ দেয়া হয়।  এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার প্যাট্রিক হার্টেন এ সময় বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রন করছিলেন। স্যালিকে ফিরে আসার নির্দেশ দিয়েই তিনি লা-গার্ডিয়া থেকে সব ধরনের বিমান চলাচল বন্ধ করে দেন। কিন্তু ক্যাপ্টেন স্যালি জানান যে লা-গার্ডিয়া বিমান বন্দরে ফিরে আসা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয় তৎক্ষনে উড্ডয়ন গতি বন্ধ হয়ে বিমানটি ধীরে ধীরে নীচের দিকে নামতে শুরু করেছে।  ক্যাপ্টেন এটিসিকে জানান যে নিউ জার্সির টিটেরবরো বিমান বন্দরে তিনি অবতরনের চেষ্টা করছেন। পর ক্ষনেই স্যালি  জানান যে টিটেরবরোতে অবতরন করাও তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না সুতরাং তিনি পার্শ্ববর্তী হাডসন নদীতেই বিমানটি অবতরন করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ১৫৫ জন যাত্রী সহ এয়ারবাস এ ৩২০ এর মত একটি বাণিজ্যিক বিমান নদী অথবা সাগরে অবতরন করানোর ঘটনা আগেও বেশ কয়েকবার ঘটেছে কিন্তু কোনটির ফলাফল ভাল হয় নি। বিমান ধংস হয়েছে, প্রাণহানীও ঘটেছে। সুতরাং ফ্লাইট ১৫৪৯কে হাডসন নদীতে অবতরন করানোর সিদ্ধান্তটি খুব সহজ ছিল না ক্যাপ্টেন স্যালির কাছে।  এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলও এই সিদ্ধান্তে আঁতকে উঠেছিল কারন এই বিমানটির দুই ডানায় অবস্থিত বিশাল দুইটি জেনারেল ইলেক্ট্রীক ইন্জিন হচ্ছে পানিতে অবতরনের সবচাইতে বড় বাঁধা। ডানা দুটিকে সঠিকভাবে এলাইন না করে পানিতে নামলে ইন্জিন দুটির সাথে পানির সংঘর্ষের কারনে বিমানটি দুটুকরো হয়ে যাবে এবং সাথে সাথে পানিতে তলিয়ে যাবে।  কিন্তু, বিপদের সমূহ সম্ভাবনা থাকা সত্বেও স্যালি বিমানটিকে হাডসন নদীতে অবতরন করানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে যাত্রীদের বিষয়টি জানালেন। ইতোমধ্যেই যাত্রীরা ইন্জিন দুটি নষ্ট হওয়া সম্বন্ধে জানতে পেরেছেন এবং সমূহ বিপদের আশংকা করছেন। সুতরাং পাবলিক এড্রেস সিস্টেমে ক্যাপ্টেন যখন জানালেন যে তিনি হাডসন নদীতে প্লেনটি নামাবেন তখন যাত্রীদের মধ্যে তেমন আতংক দেখা যায় নি। এর মধ্যে বিমানটি প্রাইমারী রাডারের আওতার নীচে চলে যাওয়ায় এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পরেছিল এবং কন্ট্রোলার প্যাট্রিক হার্টেন বিমানটি ধংস হয়ে যাওয়ার আশংকা করছিলেন।  তারপরও বিমানটির সাথে যোগাযোগের প্রচেষ্টা চলতে থাকলো এবং ঐ মুহুর্তে আকাশে উড়তে থাকা বিমান এবং হেলিকপ্টার সমূহকে বিমানটি খুঁজে বেড় করার নির্দেশ দেয়া হল। নিউইয়র্কের আকাশে প্রায় সব সময়েই সংবাদ মাধ্যম কর্মী অথবা টুরিষ্টদের বহনকারী হেলিকপ্টার দেখা যায়।  এ ধরনের একটি ট্যুরিষ্ট হেলিকপ্টার বিমানটিকে হাডসন নদীর উপরে সমান্তরালভাবে উড়তে থাকা অবস্থায় দেখতে পেয়ে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলকে জানায় এবং সাথে সাথে এটিসি বিমানটিকে অনুসরণ ও এটিসিকে সার্বক্ষনিকভাবে তথ্য প্রদাান করার জন্য হেলিকপ্টারটিকে দায়ীত্ব দেয়। ক্যাপ্টেন স্যালি মাত্র ৯০০ ফুট উপর দিয়ে জর্জ ওয়াশিংটন ব্রীজ অতিক্রম করে অবতরনের জন্য বিমানটিকে নদীর সাথে সরাসরি লাইন আপ করেন।  

বিকেল ৩টা ৩১ মিনিটে ক্যাকটাস ১৫৪৯ ঘন্টায় প্রায় ১৩০ নট্যিক্যাল মাইল গতিতে ইন্জিন বন্ধ অবস্থায় হাডসন নদীর উত্তর অংশে পানিতে অবতরন করে।  বিমানটির অবতরন স্থানটিতে তখন ভাটার স্রোত ছিল এবং থেমে থাকা অবস্থায় স্রোতের কারনে বিমানটি ক্রমশ: দক্ষিন দিকে ভেসে যেতে থাকে। বিমানটি থেমে গেলে ক্যাপ্টেন স্যালি ক্ষয় ক্ষতির হিসাব নিয়ে জানতে পারেন যে ১৫০ জন যাত্রী এবং তিনজন ফ্লাইট অ্যাটেন্ড্যান্টদের সবাই জীবিত রয়েছে এবং বড় ধরনের কোন ক্ষয়ক্ষতি হয় নি। বিমানটি থেমে যাওয়ার সাথে সাথে ক্যাপ্টেন স্যালি যাত্রীদের ডানার উপরে অবস্থিত জরুরী বহির্গমন পথ দিয়ে বেড়িয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলে যাত্রীরা প্রথমে ডানার উপরে অবস্থান নেন এবং পরে বহির্গমন পথের ইনফ্ল্যাটেবল ভেলায় আশ্রয় গ্রহন করেন। পানির সাথে বিমানের সংঘর্ষ হওয়ার সময় ফিউজালেজে তৈরী হওয়া একটি গর্ত এবং খুলে যাওয়া কার্গো ডোর দিয়ে পানি ঢুকতে শুরু করলে ফ্লাইট অ্যাটেন্ড্যান্টরা বিমানের পেছনের দিকের যাত্রীদের সম্মুখ দিকের জরুরী বহির্গমন পথ দিয়ে বেড় করার চেষ্টা করতে থাকেন। ডানা দুটির উপর প্রচন্ড চাপ পরে এবং ডানায় অবস্থানরত সবার পায়ের নীচের অংশ হাডসনের বরফ শীতল পানিতে ভিজে যায়। বেশ কজন যাত্রী ভয় পেয়ে পানিতে লাফিয়ে পরেন। ফলে তাদের প্রাণের উপর আশংকা সৃষ্টি হয় কারন -৭ ডিগ্রী সেলসিয়াশ তাপমানের পানিতে একজন মানুষ দশ মিনিটের বেশী বেঁচে থাকতে পারে না।  সৌভাগ্যবশত: ক্যাপ্টেন স্যালি বিমানটির অবতরন স্থল নিউইয়র্ক ওয়াটারওয়ে ফেরী পথের কাছাকাছি নির্ধারন করেছিলেন ফলে অবতরনের কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রথমে থমাস জেফারসন এবং পরে গভর্নর থমাস এইচ কীন নামের দুটো ফেরী এসে উদ্ধার কাজ আরম্ভ করে। পরবর্তীতে নিউইয়র্ক ফায়ার ডিপার্টমেন্টের উদ্ধারকর্মীরা বিমান অবতরনস্থলে এসে উদ্ধার কর্মে সহায়তা করে। বিকেল ৩টা ৫৫ মিনিটে বিমানের সকল যাত্রী ও ক্রুদের উদ্ধার করা হয়।

হাডসন নদীতে নষ্ট হয়ে যাওয়া বিমান অবতরন করিয়ে ক্যাপ্টেন স্যালি একটি ইতিহাস সৃষ্টি করলেও অনেকে একে সৃষ্টিকর্তার একটি মিরাক্যল বা মহিমা হিসেবে গণ্য করেন। বিশেস করে এত বড় একটি বিমান দুর্ঘটনায় একটিও প্রাণ নষ্ট না হওয়ার পেছনে সৃষ্টিকর্তার সরাসরি প্রভাব রয়েছে বলে সবাই মনে করেন। তবে একই সাথে এই বিষ্ময়কর ঘটনার জন্য ক্যাপ্টেন স্যালিকেও কৃতিত্ব প্রদান করা হয়। ঘটনাটি শোনার পর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ বলেন ফ্লাইট ১৫৪৯ এর ক্রুদের সাফল্য আমাকে সবসময় অনুপ্রানিত করবে।

হাডসন নদীতে অবতরনের পর এয়ারবাস এ ৩২০-২১৪ বিমানটি আর ব্যবহারযোগ্য থাকে নি। পরবর্তীতে এই বিমানটিকে নর্থ ক্যারোলাইনার শার্লটে অবস্থিত ক্যারলিনা এভিয়েশন মিউজিয়ামে স্থায়ী প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়েছে।
     
হলিউডের জনপ্রিয় অভিনেতা ও চিত্র পরিচালক ক্লিন্ট ইষ্টউডের পরিচালনায় স্যালি নামের একটি চলচিত্রের মাধ্যমে এই অলৌকিক ঘটনাটির চিত্রায়ন করা হয়েছে। এই চলচিত্রে ক্যাপ্টেন স্যালির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন টম হ্যাংকস।     

Sunday, October 6, 2013

এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট ১৮২: সম্রাট কনিস্কের অন্তর্ধান- প্রথম পর্ব

 
২৩শে জুন ১৯৮৫। আটলান্টিক মহা সাগরের ৩১০০০ ফিট উপর দিয়ে লন্ডনের উদ্দেশ্যে প্রচন্ড গতিতে উড়ে চলেছে ভারতীয় বাণিজ্যিক বিমান সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং ৭৪৭-২৩৭বি বিমান যার ডাক নাম সম্রাট কনিস্ক। ৩০৭ জন যাত্রী এবং ২২ জন ক্রু ‍নিয়ে বিমানটি লন্ডন হয়ে দিল্লী যাচ্ছে। ফ্লাইট ১৮২ নামে পরিচিত এয়ার ইন্ডিয়ার এই বোয়িং ৭৪৭ জাম্বোজেটটির যাত্রা শুরু হয়েছে কানাডার মন্ট্রিল থেকে।  মন্ট্রিলের মিরাবেল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে মূল যাত্রা শুরু করলেও  সম্রাট কনিস্কের প্রাথমিক যাত্রাটি শুরু হয়েছিল টরেন্টো পিয়ারসন আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে ফ্লাইট ১৮১ হিসেবে। টরেন্টো বিমান বন্দরে প্রায় এক ঘন্টা চল্লিশ মিনিট বিলম্বের পর গ্রীনিচ মাণ সময় ভোর ১২:১৫ মিনিটে টরেন্টো ত্যাগ করে বিমানটি ভোর ১.০০ টায় মন্ট্রিল পৌছে। এখানে বিমানের ফ্লাইট নাম্বারটি বদলে ১৮২ হয়ে যায়। ভারতীয় পতাকাবাহী এই বিমানটির ফ্লাইট প্ল্যানটি ছিল এরকম, আটলান্টিক পাড়ি দেয়ার পর সম্রাট কনিস্ক লন্ডনের হিথ্রো বিমান বন্দরে অবতরন করবে। লন্ডনে এক ঘন্টা অবস্থানের পর বিমানটি দিল্লীস্থ ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করবে। এই বিমানের অধীকাংশ যাত্রীই ছিলেন কানাডার নাগরিক। তবে তাঁদের মাতৃভূমি ছিল ভারত এবং তাঁরা ছুটি কাটাতেই ভারতের উদ্দেশ্যে এয়ার ইন্ডিয়ার এই ফ্লাইটটিতে আঢ়হন করেছিলেন।

এখন গ্রীনিচ মাণ সময় সকাল আটটা। সম্রাট কনিস্কের মূল পরিচালক ক্যাপ্টেন হনস সিং নরেন্দ বিমানটি নিয়ন্ত্রন করছেন। তাঁকে সহযোগীতা করছেন কো-পাইলট সতিন্দর সিং ভিন্দার এবং ফ্লাইট ইন্জিনিয়ার দারা দুমাসিয়া। সতিন্দর সিং ভিন্দার নিজেও একজন ক্যাপ্টেন তবে এই ফ্লাইটে তিনি সহকারীর দায়ীত্ব পালন করছেন। বোয়িং ৭৪৭ একটি আধুনিক বিমান। উড়ন্ত অবস্থায় বিমানটির ক্যাপ্টেনের তেমন কিছু করার থাকে না। এ সময় কো-পাইলট বা ফার্ষ্ট অফিসারই মূলত: ব্যাস্ত থাকে মাটিতে অবস্থিত এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল কেন্দ্রের সাথে রেডিও যোগাযোগ নিয়ে। সম্রাট কনিস্কের সাথে এই মূহুর্তে আয়ারল্যান্ডের শ্যানন বিমান বন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল কেন্দ্রের রেডিও যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে।  কো-পাইলট সতিন্দর সিং ভিন্দার শ্যানন কন্ট্রোলের কাছে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা অব্যাহত রাখার অনুমতি চাইলেন। শ্যানন কন্ট্রোলে দুজন কন্ট্রোলার কাজ করছেন। টমাস নেইল এবং মাইকেল কেইন তাঁদের কাজ ভাগ করে নিয়েছেন। এই মুহুর্তে দুজনে মাত্র তিনটি ফ্লাইট নিয়ে কাজ করছেন। ফ্লাইট সমুহ পরিচালনাকারী বিমান তিনটি একই লেভেলে তিনটি ভিন্ন উচ্চতায় থেকে লন্ডনের উদ্দেশ্যে চলছে। ৩৭০০০ ফিট উচ্চতায় রয়েছে কানাডা প্যাসিফিক ফ্লাইট সিপি ২৮২, ৩৫০০০ ফিট উচ্চতায় টিডব্লিউএ ফ্লাইট ৭৭০ এবং ৩১০০০ ফিট উচ্চতায় এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট ১৮২ ।

এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটটি নিয়ন্ত্রন করছেন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার মাইকেল কেইন। আকাশে উড়ন্ত বিমানগুলো পর্যবেক্ষনের জন্য তিনি একটি টু-ডায়মেনশনাল রাডার ব্যবহার করছেন ফলে রাডার মনিটরে একই লেভেলে উড়ন্ত তিনিটি বিমান একটি অন্যটির উপর অবস্থান করছে বলে মনে হচ্ছে। কন্ট্রোলার মাইকেল কেইন ফ্লাইট ১৮২ এর কো-পাইলট ক্যাপ্টেন সতিন্দর সিং ভিন্দার এর সাথে রেডিওতে কথা বললেন:

ক্যাপ্টেন ভিন্দার: শুভ সকাল শ্যানন কন্ট্রোল। এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট ১৮২ থেকে বলছি।
মাইকেল কেইন: শুভ সকাল ফ্লাইট ১৮২, তোমার অবস্থান জানাও।
ক্যাপ্টেন ভিন্দার: ৫০ ডিগ্রী দক্ষিন এবং ১৫ ডিগ্রী পশ্চিম, ফ্লাইট লেভেল ৩১০০০ হাজার ফিট।
মাইকেল কেইন: ফ্লাইট ১৮২, লেভেল ৩১০০০ ফিটে রেখে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা অব্যাহত রাখার অনুমতি দেয়া হল।
ক্যাপ্টেন ভিন্দার: ধন্যবাদ শ্যানন কন্ট্রোল, ফ্লাইট লেভেল ৩১০ রেখে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা অব্যাহত রাখছি।

এটাই ছিল ফ্লাইট ১৮২ এর সাথে শ্যানন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সর্বশেষ কথোপোকথন।

সকাল ৮:১৪ মিনিট। মাইকেল কেইন তাঁর সম্মুখস্থ  টু-ডায়মেনশনাল রাডার মনিটরে তাকিয়ে একটি অভূতপূর্ব দৃশ্য লক্ষ্য করলেন। বিভিন্ন উচ্চতায় উড়ন্ত বিমানগুলোর সংকেত সমূহ একই লেভেলে এসে একটি আরেকটির উপর প্রতিস্থাপিত হওয়ায় মনে হচ্ছিল আকাশে এই মুহুর্তে একটি মাত্র বিমান উড়ছে। মাইকেল কেইন তাঁর ট্র্যাকিং ডিভাইস ব্যবহার করে ফ্লাইট সমূহ পৃথক করার কাজ শুরু করলে পয়তাল্লিশ সেকেন্ড পরে টিডব্লিউএ এবং কানাডা প্যাসিফিক ফ্লাইট দুইটি পুনরায় রাডারে আলাদা ভাবে দেখা গেলেও  এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট ১৮২ এর কোন চিন্হ পাওয়া গেল না। মাইকেল কেইন এবং টমাস নেইল দুজনে আবার চেষ্টা করলেন কিন্তু কোন ভাবেই সম্রাট কনিস্কের ফ্লাইট সংকেতটি রাডারের পর্দায় দেখা গেল না। তাঁরা দুজনে পৃথকভাবে ফ্লাইট ১৮২ এর সাথে রেডিও যোগাযোগের চেষ্টা করলেন কিন্তু মনে হল পেছনে কোন চিন্হ না রেখেই সম্রাট কনিষ্ক বাতাসে মিলিয়ে গেছে।

সম্রাট কনিস্কের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ষাট সেকেন্ডের মধ্যে শ্যানন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল থেকে এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট ১৮২ হাড়িয়ে যাওয়ার সংবাদটি ঘোষনা করা হল। এ সময় আয়ারল্যান্ডের রাজধানী কর্ক থেকে ২৯০ কিলোমিটার দক্ষিন পশ্চিমে  ৩১০০০ ফিট উপরে বিমানটি অবস্থান করছিল।  শ্যানন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল সম্রাট কনিস্কের হাড়িয়ে যাওয়ার ঘোষনা দেয়ার সাথে সাথে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে অবস্থানরত বেশ কটি জাহাজ বিমানটি খুঁজতে থাকে। ঠিক দু ঘন্টা পর লরেনশিয়ান ফরেষ্ট নামের একটি কানাডিয়ান মালবাহী জাহাজ সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় সম্রাট কনিষ্কের ধংসাবশেষ খুঁজে পায়। কিছুক্ষনের মধ্যেই প্রমানিত হয় যে কোন প্রকার আভাষ ইঙ্গীত ব্যাতীতই সম্রাট কনিষ্ক দুর্ঘটনায় পরে ধংস হয়ে গেছে। এমনকি, একেবারে নিখুঁতভাবে চলমান বিমানটি শেষ মুহুর্তেও কোনপ্রকার সমস্যার কথা জানায় নি। পরবর্তীতে জানা যায় বিমানের ক্যাপ্টেন ও কো-পাইলট বিমানটিতে বহন করা কিছু মালামালের কাষ্টমস ক্লিয়ারেন্স এর বিষয়ে কথা বলতে বলতেই এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

কিছুক্ষনে মধ্যেই বিমানের ধংসাবশেষের সাথে সমূদ্রে ভাসমান মৃতদেহগুলো আইরিশ নৌবাহিনীর জাহাজে করে কর্কে নিয়ে আসা হয়। ইতোমধ্যেই  নিশ্চিত হওয়া  গেছে যে সম্রাট কনিস্কের যাত্রী এবং ক্রুদের মধ্যে সবাই দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। দূর্ঘটনার সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পরতেই ভারতের এয়ার এক্সিডেন্ট ইনভেষ্টিগেশন ব্যুরোর বিমান দূর্ঘটনা তদন্তকারী দল আয়ারল্যান্ডে উপস্থিত হল। ভারতীয় তদন্তকারী দলের প্রধান এইচ এস খোলা আইরিশ তদন্ত দলের সাথে যোগ দেন। ইতোমধ্যে আটলান্টিক মহাসাগরে ভাসমাণ অবস্থায় মোট ১৩২টি মৃতদেহ উদ্ধার করে কর্কে নিয়ে আসা হয়েছে। কর্ক সিটি হসপিটালের প্রধান প্যাথোলজিষ্ট ড: কিউমিন ডয়েল এর উপর  উদ্ধারকৃত মৃতদেহগুলো অটপ্সি বা পরীক্ষা করার দায়ীত্ব পরলো এবং তিনি প্রথম মৃতদেহটি হাসপাতালে পৌছার সাথে সাথেই অটপ্সি শুরু করলেন। অটপ্সি করার  উদ্দেশ্য ছিল বিমান দূর্ঘটনার মূল কারনটি সম্বন্ধে জানা। পরবর্তী চার দিনে মোট ১৩২টি মৃতদেহ পরীক্ষা করা হলে একটি বিষ্ময়কর ফলাফল বেড়িয়ে আসে। ড: ডয়েল জানালেন অধীকাংশ যাত্রীদের মৃত্যু হয়েছে আকাশে থাকা অবস্থায় অর্থাৎ বিমান উড়ন্ত অবস্থায় এমন কিছু ঘটেছিল যার কারনে যাত্রীদের হঠাৎ মৃত্যু হয়। তিনি পরীক্ষা করে জানতে পারেন যে  বেশীর ভাগ যাত্রীদের পড়নের কাপড় ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল যা প্রমান করে যে মৃত্যুর সময় তারা সবাই প্রায় ৩০০০০ ফিট উপরে বিমান থেকে ছিটকে বেড়িয়ে গিয়েছিলেন। অটপ্সিতে আরও দেখা যায় অধীকাংশ যাত্রীদের দেহের বিভিন্ন অংশের হাড় হয় ভেঙ্গে গেছে অথবা জোড়া খুলে গেছে।

ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও ভারতের তদন্তকারীরা এই পর্যায়ে নিশ্চিত হলেন যে বিমানটি আকাশে ৩১০০০ ফিট উপরে থাকতেই দূর্ঘটনার কবলে পরে এবং হঠাৎ করেই বিস্ফোরিত হয় ফলে যাত্রী এবং ক্রুদের সবাই মৃত্যু বরণ করেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আকাশের ৩১০০০ ফিট উপরে এমন কি ঘটেছিল যে বিমানটি বিষ্ফোরিত হল? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য আন্তর্জাতিক বিমান দূর্ঘটনা তদন্তকারী দল তাঁদের সর্বশক্তি নিয়ে তদন্ত শুরু করলেন।

দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্য   

Thursday, September 12, 2013

এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইট ৪৫৯০: অন্তিম যাত্রায় আকাশের রানী কনকর্ড- শেষ পর্ব

২৫শে জুলাই ২০০০ বিকেল :৫০ মিনিট যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক জন এফ কে বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়ার দশ মিনিটের মধ্যে এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইট ৪৫৯০ পরিচালনায় ব্যবহৃত কনকর্ড বিমানটি ১০৯ জন যাত্রী ক্রু সহ প্যারিসের শার্ল দ্য গল বিমান বন্দরের অদূরে গনেসী নামক স্থানে বিধ্বস্ত হয়েছে শার্ল দ্যা গল বিমান বন্দরের টাওয়ার থেকে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার জিল লজলাঁ দুর্ঘটনাটি প্রথম থেকেই দেখছিলেন দুর্ঘটনাটি ঘটার প্রায় সাথে সাথেই উদ্ধার কর্মীরা দুর্ঘটনাস্থলে হাজির হলেও প্রজ্বলিত আগুনের প্রচণ্ড তাপের কারণে উদ্ধার কাজ আরম্ভ করতে পারে নি ইতোমধ্যে লে রেলিস ব্লিউস নামক হোটেলটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে গেছে এবং হোটেলের চার জন কর্মীর মৃত্যু হয়েছে

কনকর্ড দুর্ঘটনার সংবাদটি খুব দ্রুত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে পরে এবং বাণিজ্যিক বিমান চলাচল দুনিয়ায় মহা বিস্ময়ের সৃষ্টি হয় এই অসম্ভব দুর্ঘটনার তদন্তের জন্য ফ্রান্স সরকার এয়ার এক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরোকে দায়িত্ব প্রদান করে সন্ত্রাসীদের পেতে রাখা বোমার কারণেই এই দুর্ঘটনাটি হয়েছে বলে প্রথমে সন্দেহ করা হয় ধারনা করা হয় যাত্রীদের লাগেজে রাখা কোন ধরনের বিস্ফোরক এই প্রচণ্ড আগুনের জন্য দায়ী এই সন্দেহ প্রমাণের জন্য তদন্তকারীরা দুর্ঘটনাস্থল থেকে বিধ্বস্ত কনকর্ডের সবগুলো অংশ সংগ্রহ করে লে বোর্জ বিমান বন্দরের তিনটি হ্যাঙ্গারে জমা করেন তদন্তকারীরা শার্ল দ্য গল বিমান বন্দরের যে রানওয়ে থেকে কনকর্ড শেষবারের মত উড্ডয়ন করেছিল সেই ২৬ আর রানওয়েটিকেও ভালভাবে পর্যবেক্ষন করতে গিয়ে অনেকগুলো অস্বাভাবিক বস্তু খুঁজে পান যেগুলো কোন অবস্থাতেই রানওয়েতে থাকার কথা নয় এই অস্বাভাবিক প্রকৃতির বস্তুগুলো সংগ্রহ করে বিশ্লেষণের জন্য বিইএ ল্যাবে পাঠানো হয় তদন্তের এই পর্যায়ে সন্ত্রাসীদের পেতে রাখা বোমায় বিমান ধংসের তত্বটি বাতিল হয়ে যায় কারণ ধংসাবশেষ থেকে সংগ্রহ করা বিমানের বিভিন্ন পার্টস পরীক্ষা করে বিস্ফোরনের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি তবে রানওয়ে ২৬ আর থেকে সংগ্রহিত বস্তুগুলো পরীক্ষা করার পর দুটি প্রতি তদন্তকারীদের মনোযোগ আকর্ষিত হয় প্রথমটি একটি রাবারের টুকরো যা ওজনে প্রায় . কেজির মত অপরটি একটি টাইটানিয়ামের তৈরি অ্যালয় স্ট্রিপ যা লম্বায় প্রায় ১৭ ইঞ্চি বিশ্লেষণের মাধ্যমে জানা যায়, রাবারের টুকরোটি কনকর্ড বিমানটির চাকার একটি অংশ এবং ধারালো কোন বস্তুর আঘাতে রাবারের টুকরোটি চাকা থেকে খুলে এসেছে তদন্তকারীরা টাইটানিয়াম অ্যালয় স্ট্রিপ পরীক্ষা করে জানতে পারেন যে এটি ম্যাকডোনাল্ড ডগলাস কোম্পানির তৈরি ডিসি ১০-৩০ বিমান ইঞ্জিনের কভারের একটি অংশ এবং এই স্ট্রিপটি কনকর্ড উড্ডয়নের পাঁচ মিনিট পূর্বে কন্টিনেন্টাল এয়ারলাইন্সের যে বিমানটি ২৬ আর রানওয়ে থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সির উদ্দেশ্যে উড়ে গিয়েছিল, সেই ডিসি ১০-৩০ বিমান ইঞ্জিনের কভার থেকে খুলে রানওয়েতে পরে যায়
দীর্ঘ তদন্ত শেষে ফ্রান্সের এয়ার এক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো ২০০২ এর জানুয়ারি মাসে কনকর্ড দুর্ঘটনার পুর্নাঙ্গ রিপোর্ট প্রকাশ করে তদন্তকারীরা দুর্ঘটনাস্থলে এবং এর আশে পাশে প্রাপ্ত সব ধরনের বর্জ্য চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে কনকর্ড দুর্ঘটনার মূল রহস্যটি ভেদ করেন বিইএ রিপোর্টের সারসংক্ষেপে দুর্ঘটনার বিবরণটি ছিল এরকম:
বিকেল :৩০ মিনিটে কন্টিনেন্টাল এয়ারলাইন্সের ডিসি ১০-৩০ বিমানটি ২৬ আর রানওয়ে থেকে উড্ডয়নের সময় বিমান ইঞ্জিনের কভার থেকে ১৭. ইঞ্চি লম্বা এবং . ইঞ্চি চওড়া টাইটানিয়াম অ্যালয় স্ট্রিপ খুলে রানওয়েতে পরে যায় কনকর্ড উড্ডয়নের পূর্বে তার জন্য নির্ধারিত রানওয়ে ভালভাবে পরীক্ষা করে দেখার যে নিয়ম আছে, সময়াভাবে সে পরীক্ষাটি করা হয় নাই বিধায় স্ট্রিপটি রানওয়েতে পরে থাকে বিকেল :৩৫ মিনিটে কনকর্ড রানওয়ে ২৬ আর এর ডিপারচার পয়েন্ট থেকে যাত্রা শুরু করে সময় কনকর্ডের মোট ওজন তার সর্বোচ্চ ওজন থেকে ৮৩০ কেজি বেশী ছিল এবং ধারনা করা হয় যে কনকর্ডের লাগেজ হোল্ডে যাত্রীদের লাগেজ ওজন অনুযায়ী সঠিকভাবে ভারসাম্য বজায় রেখে সাজানো হয় নি বিধায় চলন্ত অবস্থায় কনকর্ড ধীরে ধীরে রানওয়ের বা দিকে চলে আসে এই সময় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাককে বহনকারী একটি বোয়িং ৭৪৭ বিমানের প্রায় কাছে চলে যায় বোয়িং ৭৪৭ বিমানটি ২৬ আর রানওয়ের নিকটস্থ আরেকটি রানওয়েতে অবতরণ করছিল তদন্তকারীরা লক্ষ্য করেন যে কনকর্ড রানওয়েতে তার সর্বশেষ উড্ডয়ন পয়েন্ট অতিক্রম করার পরেও ভি১ গতিবেগ অর্জনে ব্যর্থ হয় অতিরিক্ত ওজনের কারণে এক পর্যায়ে বিমানটি সর্বশেষ উড্ডয়ন পয়েন্ট থেকে বেশ কিছু দূরে এসে ভি১ গতিবেগ অর্জন করে এবং এই পর্যায়ে কনকর্ডের বা দিকের চাকা রানওয়েতে পরে থাকা টাইটানিয়াম অ্যালয় স্ট্রিপের উপর এসে পরলে ধারালো স্ট্রিপের আঘাতে চাকা থেকে প্রায় . কিলোগ্রাম ওজনের একটি টুকরো কেটে বেড়িয়ে এসে ডান দিকের ডানার নীচে আঘাত করে সময় বিমানের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ৩১০ কিলোমিটার রাবারের টুকরোটি প্রচণ্ড গতিতে ডানার নীচে আঘাত করায় একটি শক ওয়েভের সৃষ্টি হলে নং ফুয়েল ট্যাংকের সবচাইতে দুর্বল জায়গাটি ছিদ্র হয়ে জেট ফুয়েল বেড়িয়ে আসতে থাকে একই সময় রাবারের টুকরোটির আঘাতে বিমানের চাকার সাথে জড়িয়ে থাকা বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে গেলে সেখানে স্পার্ক সৃষ্টি হয়ে আগুন ধরে যায়
এমন একটি সময় এই ঘটনাটি ঘটে যখন বিমানের গতি ছিল ভি১ অর্থাৎ এই গতিবেগে বিমানের পাইলটদের একটিই করনীয় থাকে আর তা হল রানওয়ে ত্যাগ করা পাঁচ নং ফুয়েল ট্যাংকের ছিদ্র দিয়ে তেল বেড়িয়ে যেতে থাকায় নং ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে আবার চালু হয় কিন্তু আগুন ধরে যাওয়ার পর ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার নং ইঞ্জিনটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন ফলে আকাশে উপরের দিকে উঠে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির অভাবে বিমানটির গতি ধীরে ধীরে কমতে থাকে অপর দিকে বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে যাওয়ায় বিমানের চাকাগুলো হোল্ডে নেয়া সম্ভব হয় না ফলে চাকাগুলোর ওজন বিমানটিকে নীচের দিকে টানতে থাকেমাটি থেকে মাত্র ২০০ ফিট উচ্চতায় যাওয়ার পর বিমানটির উপরে উঠা বন্ধ হয়ে যায়, ডানদিকে ডানা ভেঙ্গে পরে এবং বিমানটি বাম দিকে ১০০ ডিগ্রী হেলে পরে গনেসীস্থ হোটেল লে রিলেইস ব্লিউ এর উপর পরে যায়

এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইট ৪৫৯০ দুর্ঘটনার পর ফ্রান্স সরকারের নির্দেশে কনকর্ডকে ফ্লাইট পরিচালনার অনুপযুক্ত ঘোষণা করা হয় এখন পর্যন্ত কনকর্ড বিমান ব্যবহার করে বাণিজ্যিক ফ্লাইট পরিচালনা সারা বিশ্বেই নিষিদ্ধ রয়েছে তবে চেষ্টা চলছে যাতে বিমানটিকে আরও নিরাপদ করে পুনরায় যাত্রী পরিবহনের লাগানো যায় হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আকাশের রাণী কনকর্ড আবারো বিশ্বের বিভিন্ন বিমান বন্দরে যাত্রী পরিবহন শুরু করবে, কনকর্ড প্রেমী বিশ্বের অসংখ্য মানুষ এই আশাবাদ নিয়েই কনকর্ডের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার জন্য কাজ করছেন