Sunday, January 15, 2017



হাডসনে মির‌্যাকল

১৫ই জানুয়ারী ২০০৯, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র। বিকেল ৩টা বেজে ২০ মিনিট। ইউএস এয়াওয়েজের ফ্লাইট ১৫৪৯ (ক্যাকটাস ১৫৪৯) নিউইয়র্কের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিমান বন্দর লা-গার্ডিয়ার চার নম্বর রানওয়েতে ডিপারচার নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছে।  এই ফ্লাইটটিতে ব্যবহৃত হবে এয়াবাস ৩২০-২১৪ সিরিজের একটি বিমান। ইউরোপের বিমান নির্মাতা এয়ারবাস ইন্ডাষ্ট্রিজের তৈরী এয়ারবাস ৩২০ সিরিজের বিমানগুলো মধ্যম পাল্লার ফ্লাইটের জন্য অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য এবং পরিচালনা ব্যয় অপেক্ষাকৃত কমের কারনে এয়ালাইন্স সমূহের জন্য লাভজনক বিবেচিত হওয়ায় ইউএস এয়ারওয়েজ মোট ৭৪টি এ-৩২০ বিমান যাত্রী পরিবহনে ব্যবহার করে। ক্যকটাস ১৫৪৯ ফ্লাইটটিতে ব্যবহৃত বিমানটি ১৯৯৯ সনে তৈরী হয়ে ইউএস এয়ারওয়েজের বিমান বহরে যুক্ত হয়েছে এবং দশ বছরে মোট ১৬২৯৯টি ফ্লাইট পরিচালনার মাধ্যমে মোট ২৫২৪১ ফ্লাইট ঘন্টা উড্ডয়ন করেছে। আজকের ফ্লাইটি নিউইয়র্কের লা-গার্ডিয়া বিমান বন্দর থেকে উড্ডয়ন করে ওয়াশিংটন রাজ্যের রাজধানী সিয়েটলের টাকোমা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে উড়ে যাবে। তবে মাঝখানে নর্থ ক্যারোলাইনার শার্লট ডগলাস বিমান বন্দরে কিছুক্ষনের জন্য যাত্রা বিরতী করবে। বিমানটিতে মোট যাত্রী রয়েছেন ১৫০ জন, বিমানটি পরিচালনা করবেন দুজন ক্রু। ফ্লাইট কমান্ডার ক্যাপ্টেন চেলসি বি “সালি” সালেনবার্গার একজন অভিজ্ঞ বিমান চালক যার মোট ১৯৬৬৩ ঘন্টা উড্ডয়ন অভিজ্ঞতা রয়েছে। এয়ারবাস এ ৩২০ পরিচালনায় তার রয়েছে ৪৭৬৫ ঘন্টার অভিজ্ঞতা। তরুন বয়সে তিনি যুক্তরাষ্ট্র বিমান বাহিনীতে এফ-১৬ ফাইটার বিমানের পাইলট ছিলেন। গ্লাইডার পাইলট হিসেবেও তার সুখ্যাতি রয়েছে। আজকের ফ্লাইট পরিচালনায় সালিকে সহায়তা করবেন ফার্ষ্ট অফিসার জেফ্রী বি স্কাইলস। জেফ্রীও একজন অভিজ্ঞ পাইলট এবং ১৫৬৪৩ ফ্লাইট ঘন্টার অধিকারী। তবে আজকের ফ্লাইটটিই তার প্রথম এ ৩২০ ফ্লাইট। এই ফ্লাইটে যাত্রীদের সেবা প্রদানের জন্য মোট তিনজন ষ্টুয়ার্ডেস রয়েছেন যাদের নের্তৃত্বে রয়েছেন ডোনা ডেন্ট।

বিকেল ৩টা বেজে ২৪ মিনিটে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল ফ্লাইট ১৫৪৯কে চার নং রানওয়ের উত্তর পূর্ব  দিক থেকে উড্ডয়নের অনুমতি প্রদান করলে এক মিনিটের মধ্যেই ফার্ষ্ট অফিসার জেফ্রীর নিয়ন্ত্রনে বিমানটি শার্লটের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। বিমানটি সাতশ ফুট উপরে উঠার পর কমান্ডার স্যালি এটিসিকে বিমানের অবস্থান জানালেন। বিকেল ৩টা বেজে ২৭ মিনিট ১১ সেকেন্ড, আড়োহনের এই পর্যায়ে বিমানটি রয়েছে মাটি থেকে ২৮১৮ ফিট উপরে। ঠিক এই সময়েই কানাডিয়ান গীজ নামক এক ঝাক হাঁস জাতীয় পাখীর সাথে বিমানটির সংঘর্ষ হল। বিমানের পাইলট দ্বয় এবং অনেক যাত্রী এই সংঘর্ষের শব্দ পেলেন। সংঘর্ষের সাথে সাথেই বিমানটির উভয় ইন্জিনে আগুন ধরে যায় এবং প্রায় একই সাথে ইন্জিন দুটো বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় বিমানটি নিউইয়র্ক শহরে হাডসন নদীর উপরে নির্মিত জর্জ ওয়াশিংটন ব্রীজের উত্তর পূর্ব কোনে অবস্থান করছিল। উড্ডয়নের পর মাত্র ২ মিনিট ৭ সেকেন্ড কেটেছে, এর মধ্যে বিমানের প্রাণ শক্তির উৎস ইন্জিনগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ায় উড্ডয়ন ধীর হয়ে পরে এবং বিমানটি আরও ১৯ সেকেন্ড ধরে ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠতে থাকে। ইন্জিন বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে কমান্ডার স্যালি বিমানের নিয়ন্ত্রন গ্রহন করে ফার্ষ্ট অফিসার জেফ্রীকে ইন্জিনগুলো চালু করার জন্য চেষ্টা করতে বলেন। জেফ্রী এয়াবাস এ ৩২০ ম্যানুয়েল অনুসরন করে নষ্ট হওয়া ইন্জিন চালু করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।  বিকেল ৩টা বেজে ২৭ মিনিট ৩৬ সেকেন্ডে ক্যাপ্টেন স্যালি নিউইয়র্ক টার্মিনাল এপ্রোচ কন্ট্রোলকে পাখীর সাথে সংঘর্ষ ও বিমানের ইন্জিন বন্ধ হয়ে যাওয়ার সংবাদ দিলে ট্রাকন থেকে তাঁকে বিমান বন্দরে ফিরে আসার নির্দেশ দেয়া হয়।  এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার প্যাট্রিক হার্টেন এ সময় বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রন করছিলেন। স্যালিকে ফিরে আসার নির্দেশ দিয়েই তিনি লা-গার্ডিয়া থেকে সব ধরনের বিমান চলাচল বন্ধ করে দেন। কিন্তু ক্যাপ্টেন স্যালি জানান যে লা-গার্ডিয়া বিমান বন্দরে ফিরে আসা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয় তৎক্ষনে উড্ডয়ন গতি বন্ধ হয়ে বিমানটি ধীরে ধীরে নীচের দিকে নামতে শুরু করেছে।  ক্যাপ্টেন এটিসিকে জানান যে নিউ জার্সির টিটেরবরো বিমান বন্দরে তিনি অবতরনের চেষ্টা করছেন। পর ক্ষনেই স্যালি  জানান যে টিটেরবরোতে অবতরন করাও তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না সুতরাং তিনি পার্শ্ববর্তী হাডসন নদীতেই বিমানটি অবতরন করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ১৫৫ জন যাত্রী সহ এয়ারবাস এ ৩২০ এর মত একটি বাণিজ্যিক বিমান নদী অথবা সাগরে অবতরন করানোর ঘটনা আগেও বেশ কয়েকবার ঘটেছে কিন্তু কোনটির ফলাফল ভাল হয় নি। বিমান ধংস হয়েছে, প্রাণহানীও ঘটেছে। সুতরাং ফ্লাইট ১৫৪৯কে হাডসন নদীতে অবতরন করানোর সিদ্ধান্তটি খুব সহজ ছিল না ক্যাপ্টেন স্যালির কাছে।  এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলও এই সিদ্ধান্তে আঁতকে উঠেছিল কারন এই বিমানটির দুই ডানায় অবস্থিত বিশাল দুইটি জেনারেল ইলেক্ট্রীক ইন্জিন হচ্ছে পানিতে অবতরনের সবচাইতে বড় বাঁধা। ডানা দুটিকে সঠিকভাবে এলাইন না করে পানিতে নামলে ইন্জিন দুটির সাথে পানির সংঘর্ষের কারনে বিমানটি দুটুকরো হয়ে যাবে এবং সাথে সাথে পানিতে তলিয়ে যাবে।  কিন্তু, বিপদের সমূহ সম্ভাবনা থাকা সত্বেও স্যালি বিমানটিকে হাডসন নদীতে অবতরন করানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে যাত্রীদের বিষয়টি জানালেন। ইতোমধ্যেই যাত্রীরা ইন্জিন দুটি নষ্ট হওয়া সম্বন্ধে জানতে পেরেছেন এবং সমূহ বিপদের আশংকা করছেন। সুতরাং পাবলিক এড্রেস সিস্টেমে ক্যাপ্টেন যখন জানালেন যে তিনি হাডসন নদীতে প্লেনটি নামাবেন তখন যাত্রীদের মধ্যে তেমন আতংক দেখা যায় নি। এর মধ্যে বিমানটি প্রাইমারী রাডারের আওতার নীচে চলে যাওয়ায় এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পরেছিল এবং কন্ট্রোলার প্যাট্রিক হার্টেন বিমানটি ধংস হয়ে যাওয়ার আশংকা করছিলেন।  তারপরও বিমানটির সাথে যোগাযোগের প্রচেষ্টা চলতে থাকলো এবং ঐ মুহুর্তে আকাশে উড়তে থাকা বিমান এবং হেলিকপ্টার সমূহকে বিমানটি খুঁজে বেড় করার নির্দেশ দেয়া হল। নিউইয়র্কের আকাশে প্রায় সব সময়েই সংবাদ মাধ্যম কর্মী অথবা টুরিষ্টদের বহনকারী হেলিকপ্টার দেখা যায়।  এ ধরনের একটি ট্যুরিষ্ট হেলিকপ্টার বিমানটিকে হাডসন নদীর উপরে সমান্তরালভাবে উড়তে থাকা অবস্থায় দেখতে পেয়ে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলকে জানায় এবং সাথে সাথে এটিসি বিমানটিকে অনুসরণ ও এটিসিকে সার্বক্ষনিকভাবে তথ্য প্রদাান করার জন্য হেলিকপ্টারটিকে দায়ীত্ব দেয়। ক্যাপ্টেন স্যালি মাত্র ৯০০ ফুট উপর দিয়ে জর্জ ওয়াশিংটন ব্রীজ অতিক্রম করে অবতরনের জন্য বিমানটিকে নদীর সাথে সরাসরি লাইন আপ করেন।  

বিকেল ৩টা ৩১ মিনিটে ক্যাকটাস ১৫৪৯ ঘন্টায় প্রায় ১৩০ নট্যিক্যাল মাইল গতিতে ইন্জিন বন্ধ অবস্থায় হাডসন নদীর উত্তর অংশে পানিতে অবতরন করে।  বিমানটির অবতরন স্থানটিতে তখন ভাটার স্রোত ছিল এবং থেমে থাকা অবস্থায় স্রোতের কারনে বিমানটি ক্রমশ: দক্ষিন দিকে ভেসে যেতে থাকে। বিমানটি থেমে গেলে ক্যাপ্টেন স্যালি ক্ষয় ক্ষতির হিসাব নিয়ে জানতে পারেন যে ১৫০ জন যাত্রী এবং তিনজন ফ্লাইট অ্যাটেন্ড্যান্টদের সবাই জীবিত রয়েছে এবং বড় ধরনের কোন ক্ষয়ক্ষতি হয় নি। বিমানটি থেমে যাওয়ার সাথে সাথে ক্যাপ্টেন স্যালি যাত্রীদের ডানার উপরে অবস্থিত জরুরী বহির্গমন পথ দিয়ে বেড়িয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলে যাত্রীরা প্রথমে ডানার উপরে অবস্থান নেন এবং পরে বহির্গমন পথের ইনফ্ল্যাটেবল ভেলায় আশ্রয় গ্রহন করেন। পানির সাথে বিমানের সংঘর্ষ হওয়ার সময় ফিউজালেজে তৈরী হওয়া একটি গর্ত এবং খুলে যাওয়া কার্গো ডোর দিয়ে পানি ঢুকতে শুরু করলে ফ্লাইট অ্যাটেন্ড্যান্টরা বিমানের পেছনের দিকের যাত্রীদের সম্মুখ দিকের জরুরী বহির্গমন পথ দিয়ে বেড় করার চেষ্টা করতে থাকেন। ডানা দুটির উপর প্রচন্ড চাপ পরে এবং ডানায় অবস্থানরত সবার পায়ের নীচের অংশ হাডসনের বরফ শীতল পানিতে ভিজে যায়। বেশ কজন যাত্রী ভয় পেয়ে পানিতে লাফিয়ে পরেন। ফলে তাদের প্রাণের উপর আশংকা সৃষ্টি হয় কারন -৭ ডিগ্রী সেলসিয়াশ তাপমানের পানিতে একজন মানুষ দশ মিনিটের বেশী বেঁচে থাকতে পারে না।  সৌভাগ্যবশত: ক্যাপ্টেন স্যালি বিমানটির অবতরন স্থল নিউইয়র্ক ওয়াটারওয়ে ফেরী পথের কাছাকাছি নির্ধারন করেছিলেন ফলে অবতরনের কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রথমে থমাস জেফারসন এবং পরে গভর্নর থমাস এইচ কীন নামের দুটো ফেরী এসে উদ্ধার কাজ আরম্ভ করে। পরবর্তীতে নিউইয়র্ক ফায়ার ডিপার্টমেন্টের উদ্ধারকর্মীরা বিমান অবতরনস্থলে এসে উদ্ধার কর্মে সহায়তা করে। বিকেল ৩টা ৫৫ মিনিটে বিমানের সকল যাত্রী ও ক্রুদের উদ্ধার করা হয়।

হাডসন নদীতে নষ্ট হয়ে যাওয়া বিমান অবতরন করিয়ে ক্যাপ্টেন স্যালি একটি ইতিহাস সৃষ্টি করলেও অনেকে একে সৃষ্টিকর্তার একটি মিরাক্যল বা মহিমা হিসেবে গণ্য করেন। বিশেস করে এত বড় একটি বিমান দুর্ঘটনায় একটিও প্রাণ নষ্ট না হওয়ার পেছনে সৃষ্টিকর্তার সরাসরি প্রভাব রয়েছে বলে সবাই মনে করেন। তবে একই সাথে এই বিষ্ময়কর ঘটনার জন্য ক্যাপ্টেন স্যালিকেও কৃতিত্ব প্রদান করা হয়। ঘটনাটি শোনার পর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ বলেন ফ্লাইট ১৫৪৯ এর ক্রুদের সাফল্য আমাকে সবসময় অনুপ্রানিত করবে।

হাডসন নদীতে অবতরনের পর এয়ারবাস এ ৩২০-২১৪ বিমানটি আর ব্যবহারযোগ্য থাকে নি। পরবর্তীতে এই বিমানটিকে নর্থ ক্যারোলাইনার শার্লটে অবস্থিত ক্যারলিনা এভিয়েশন মিউজিয়ামে স্থায়ী প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়েছে।
     
হলিউডের জনপ্রিয় অভিনেতা ও চিত্র পরিচালক ক্লিন্ট ইষ্টউডের পরিচালনায় স্যালি নামের একটি চলচিত্রের মাধ্যমে এই অলৌকিক ঘটনাটির চিত্রায়ন করা হয়েছে। এই চলচিত্রে ক্যাপ্টেন স্যালির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন টম হ্যাংকস।     

No comments:

Post a Comment