Thursday, June 27, 2013

দিল্লীর মধ্য আকাশে সংঘর্ষ- ইতিহাসের তৃতীয় ভয়ংকরতম বিমান দুর্ঘটনা - প্রথম পর্ব























ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লী। ১২ই নভেম্বর ১৯৯৬ সন। প্রায় সন্ধ্যা। দিল্লীতে শীত প্রায় আসি আসি করছে। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমের দিনগুলো কেটে গিয়ে প্রকৃতিতে তাই এক স্বস্তিকর আনন্দের আমেজ। ইন্দিরা গান্ধি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। ভারতের প্রবেশ দ্বার। ১৯৯০ সনের পূর্ব পর্যন্ত এটি ছিল এয়ার ইন্ডিয়া এবং ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স, ভারত সরকার নিয়ন্ত্রিত এই দুটো বিমান সংস্থার জন্য নির্ধারিত ছোট একটি বিমান বন্দর। নব্বই সনের পর ভারত সরকার “ওপেন স্কাই” নীতি গ্রহণ করে বেশ কটি দেশের সাথে আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল চুক্তি স্বাক্ষর করলে বিমান বন্দরটি অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে উঠে। বিমান চলাচলের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায়, অনেকগুলো বিদেশী বিমান সংস্থা এই বিমান বন্দরটি ব্যবহার করা শুরু করে। এদের মধ্যে অন্যতম হল সাউদিয়া-সৌদি এরাবিয়ান এয়ারলাইন্স। ভারত থেকে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার যাত্রী মধ্যপ্রাচ্যে তাঁদের কর্মস্থলে যাতায়াত করে থাকেন। এই যাত্রীদের বড় একটি অংশ সাউদিয়ার বিমান পরিসেবা গ্রহণ করেন। তবে ইন্দিরা গান্ধি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে বিমান চলাচল অনেক বৃদ্ধি পেলেও এর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কোন পরিবর্তন হয় নি। এই ১৯৯৬ সনেও বিমান বন্দরটি নব্বই পূর্ববর্তী প্রযুক্তি ব্যবহার করেই বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছে। আধুনিক বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রনের ক্ষেত্রে সেকেন্ডারী সার্ভিল্যান্স রাডার একান্ত প্রয়োজনীয় একটি ব্যবস্থা। কিন্তু এই ১৯৯৬ সনেও ইন্দিরা গান্ধি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের এপ্রোচ কন্ট্রোলারদের নির্ভর করতে হয় প্রাচীন আমলের প্রাইমারী রাডারের উপর।

যে কোন আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের মতই বিমান চলাচলের জন্য দিল্লী বিমান বন্দরে
দু ধরনের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রয়েছে। মাটিতে থাকা অবস্থায় বিমানের নিয়ন্ত্রণ থাকে গ্রাউন্ড কন্ট্রোলের হাতে। বিমান রানওয়ে ত্যাগ করলে অথবা রানওয়েতে অবতরণের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত হয় এপ্রোচ কন্ট্রোলের মাধ্যমে।

সন্ধ্যে ৬.১৫ মিনিট। ইন্দিরা গান্ধি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের এপ্রোচ কন্ট্রোল। এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার বি কে দত্ত সবে মাত্র দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। এই মুহূর্তে এপ্রোচ কন্ট্রোলের প্রাইমারী রাডারের আওতায় মোট পাঁচটি ফ্লাইট রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি হল অগ্রাধীকারপ্রাপ্ত। টারমাকে দাড়িয়ে উড্ডয়ন অনুমতির জন্য অপেক্ষা করছে সাউদিয়া এয়ার লাইন্সের ফ্লাইট এসভিএ ৭৬৩। বিশাল দ্বিতল জাম্বোজেট বোয়িং ৭৪৭-১৬৮বি বিমানটিতে দিল্লী থেকে সৌদি আরবের দাহরান যাবেন মোট ২৮৯ জন যাত্রী। এদের বেশীর ভাগই অর্থাৎ ২১৫ জনই ভারতীয়। ৪০ জন নেপালি এবং অন্যদের মধ্যে একজন বাংলাদেশী সহ পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের নাগরিকবৃন্দ রয়েছেন। বিমানটি পরিচালনা করবে ২৩ সদস্যের ক্রুদের একটি চৌকস দল। অপর ফ্লাইট দুটো এই মুহূর্তে আকাশে রয়েছে। কাজাখস্থান এয়ার লাইন্সের ফ্লাইট কেজেডএ ১৯০৭ একটি চার্টার্ড বিমান। কিরঘিজস্তানের একটি কোম্পানি এই বিমানটি ভাড়া করেছে। রাশিয়ায় নির্মিত ইলিউশিন টু ৭৬ টিডি বিমানটিতে রয়েছে ৩৭জন যাত্রী এবং ক্রু। আকাশে উড়ন্ত অগ্রাধীকারপ্রাপ্ত অপর বিমানটি যুক্তরাষ্ট্র বিমান বাহিনীর একটি পরিবহন বিমান। লকহীড সি-১৪১বি ষ্টারলিফ্টার বিমানটি চালাচ্ছেন ক্যাপ্টেন টিমোথী জে প্লেস।  এটি  রয়েছে ২০ হাজার ফিট উপরে।

সন্ধ্যে ৬:৩২ মিনিট। সাউদিয়া ফ্লাইট এসভিএ ৭৬৩ এপ্রোচ কন্ট্রোলের অনুমতি পেয়ে রানওয়ে ত্যাগ করে নয়াদিল্লীর মেঘলা আকাশের দিকে উড়ে গেল। ঠিক একই সময়ে দিল্লী থেকে ১১৯ কিলোমিটার দূরে আকাশের ২০ হাজার ফিট উপর থেকে কাজাখ ফ্লাইট ১৯০৭ এপ্রোচ কন্ট্রোলার বি কে দত্তের কাছে ফ্লাইট লেভেল পরিবর্তনের অনুমতি চাইলে দত্ত কাজাখ ফ্লাইটিকে ১৫ হাজার ফিটে নেমে এসে স্থির হওয়ার জন্য অনুমতি দিল।  একই এয়ার করিডোরে উড়ন্ত সাউদিয়া ফ্লাইট ৭৬৩ এর জন্য নির্ধারিত ফ্লাইট লেভেল হচ্ছে ১৪ হাজার ফিট। সুতরাং ধারনা করা যায় কাজাখ ফ্লাইট ও সাউদিয়া পরস্পরকে অতিক্রম কালে দুটি বিমানের মধ্যে প্রায় ১ হাজার ফিট দূরত্ব থাকবে। সাউদিয়ার বোয়িং ৭৪৭-১৬৮বি পরিচালনা করছেন ক্যাপ্টেন খালিদ আল সুবাইলী, কো-পাইলট হচ্ছেন ফার্ষ্ট অফিসার নজর খান এবং ফ্লাইট ইন্জিনিয়ারের দায়িত্ব পালন করছেন এদ্রীস আরাবীয়া। কাজাখ ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন হলেন গেন্নাদী চেরেপেনভ এবং রেডিও অপারেটর হলেন আইগর রেপ। করিডোরে ২০ হাজার ফিট উপরে রয়েছেন ক্যাপ্টেন টিমোথী জে প্লেস। লকহীড সি-১৪১বি ষ্টারলিফ্টার বিমানটি একটি মিলিটারি বিমান হলেও আজ এর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে ইন্দিরা গান্ধি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের এপ্রোচ কন্ট্রোলার বি কে দত্তের হাতে।

সন্ধ্যে ৬:৩৯ মিনিট। সাউদিয়া ৭৬৩ এর কমান্ডার ক্যাপ্টেন খালিদ এপ্রোচ কন্ট্রোলকে জানালেন যে তিনি প্রত্যাশিত ১৪ হাজার ফিটে পৌঁছে গেছেন এবং আরও উপরে উঠার অনুমতি চাইছেন। বি কে দত্ত ক্যাপ্টেন খালিদকে ১৪ হাজার ফিট উচ্চতা বজায় রাখার নির্দেশ দিল।

সন্ধ্যে ৬:৪০ মিনিট। কাজাখ ফ্লাইট ১৯০৭ থেকে ক্যাপ্টেন গেন্নাদী এপ্রোচ কন্ট্রোলকে জানালেন যে তিনি তাঁর জন্য নির্ধারিত ১৫ হাজার ফিট উচ্চতায় নেমে এসেছেন। বি কে দত্ত গেন্নাদীর উদ্দেশ্যে বলল;

- কাজাখ ফ্লাইট ১৯০৭। ১৫ হাজার ফিটে বিমান স্থীর রাখ। তোমার বিপরীত দিক থেকে সাউদিয়ার বিমান আসছে। বিমানটি একটি বোয়িং ৭৪৭ এবং তোমার ১০ মাইলের মধ্যে রয়েছে।  সম্মুখ দিকে লক্ষ্য রাখ এবং বিমানটি দেখা মাত্র আমাকে জানাও।

কাজাখ ফ্লাইট থেকে কোন প্রত্যুত্তর না পেয়ে দত্ত আবার বলর;

- কাজাখ ফ্লাইট ১৯০৭। জবাব দাও। আমার কথা কি শুনতে পারছ?

- কাজাখ ফ্লাইট ১৯০৭। আমার কথা কি শুনতে পারছ?

কাজাখ ফ্লাইটের সাথে যোগাযোগের জন্য বি কে দত্ত বারবার চেষ্টা করা সত্বেও কোন ধরনের জবাব পাচ্ছিল না। ওদিকে প্রায় ২০ হাজার ফিট উপর দিয়ে লকহীড সি-১৪১বি ষ্টারলিফ্টার বিমানটি উড়ে আসছিল। ক্যাপ্টেন টিমোথী তাঁর বিমানের নীচে ডান দিকে ভাসমান মেঘের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। হঠাৎ তাঁর চোখের সম্মুখে কালো মেঘ কমলা রঙে আলোকিত হয়ে উঠে। ক্যাপ্টেন টিমোথী প্রথমে ভাবলেন তাঁর বিমান লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই রংটি মিলিয়ে যেতেই বুঝতে পারলেন যে মেঘের ঠিক নীচেই একটি বিস্ফোরণ ঘটেছে এবং এপ্রোচ কন্ট্রোলের সাথে যোগাযোগ করে তিনি বিস্ফোরণের কথাটি জানালেন। এর মধ্যে বি কে দত্ত উভয় ফ্লাইটের সাথে যোগাযোগের একাধিক চেষ্টা করেও কোন জবাব পায় নি। ক্যাপ্টেন টিমোথী যখন মেঘের নীচে বিস্ফোরণের কথা বলছিলেন তখনও প্রাইমারী রাডারে উভয় বিমানটিকে দেখা যাচ্ছিল। হঠাৎ করেই রাডার থেকে বিমান দুটি অদৃশ্য হয়ে গেলে বিমান দুর্ঘটনার ভয়ংকর সম্ভাবনার কথাটি বি কে দত্তের মনে আঘাত হানলো। পরক্ষনেই ক্যাপ্টেন টিমোথী জানালেন যে তিনি নীচের মাটিতে দুটি প্রজ্বলিত ধংসস্তুপ দেখতে পাচ্ছেন। ইতোমধ্যে এপ্রোচ কন্ট্রোলের অন্যান্য অপারেটররা দুর্ঘটনার বিষয়টি বুঝতে পেরে বি কে দত্তকে কক্ষের বাইরে নিয়ে গেল।

মুহূর্তের মধ্যে বিমান দুর্ঘটনার কথাটি চারিদিকে ছড়িয়ে পরে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানালেন দিল্লীর প্রায় ৬৫ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত চরখি দাদ্রি গ্রামের সরিষা ক্ষেতে দুটি বিমান ভেঙ্গে পরেছে এবং সেখানে এই মুহূর্তে আগুন জ্বলছে। বিমান দুটিতে মোট ৩৪৯ জন যাত্রী ছিল। দুটি বিমানের মধ্যে ১ হাজার ফিট দূরত্ব থাকা সত্বেও কি ভাবে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এ নিয়ে ব্যাপক প্রশ্নের জন্ম হলেও দুর্ঘটনা পরবর্তী সময়ে প্রধান যে বিষয়টি গুরুত্ব পায় তা হল উদ্ধার কাজ। দুর্ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই উদ্ধার কর্মী এবং অগ্নি নির্বাপণ দল চরখি দাদ্রি গ্রামে উপস্থিত হলেন। কিন্তু প্রজ্বলিত বিমান দুইটির আশে পাশে প্রচণ্ড তাপমাত্রার কারণে তাৎক্ষনিক ভাবে উদ্ধার কর্ম পরিচালনা সম্ভবপর না হওয়ায় অগ্নি নির্বাপণ দল আগুন নেভানোর কাজে তৎপর হলেন। কয়েক ঘণ্টা পর আগুনের তীব্রতা কমে এলে উদ্ধার কর্মীরা জীবিত এবং আহত যাত্রীদের খোঁজে তৎপর হলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠলো যে সাউদিয়া ফ্লাইট ৭৬৩ এবং কাজাখ ফ্লাইট ১৯০৭ এর যাত্রী এবং ক্রুদের মধ্যে বেশীরভাগই বিমান দ্বয় মাটিতে আছড়ে পরার সাথে সাথে নিহত হয়েছেন। শুধু কাজাখ ফ্লাইটের চারজন যাত্রীকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা গেলেও হাসপাতালে নেয়ার আগেই তাঁরা মৃত্যু বরন করেন।

বিমান দুর্ঘটনার পরপরেই এটি একটি আন্তর্জাতিক হেড লাইন নিউজে পরিণত হয়। সমগ্র বিশ্বের টিভি চ্যানেলগুলো এই দুর্ঘটনার সংবাদ বার বার প্রচার করতে থাকে। সমগ্র বিশ্ব জুড়ে একটি প্রশ্ন উচ্চারিত হতে থাকে; বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তির যুগে দু দুটি আধুনিক বিমান কি ভাবে পরস্পরকে মুখোমুখি ধাক্কা দিয়ে ধংস হয়ে যেতে পারে? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে ভারত সরকার ব্যাপক তদন্ত শুরু করে এবং এই তদন্তের দায়িত্ব প্রদান করা হয় এয়ার এক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্রাঞ্চ নামক সংস্থাটিকে।

তদন্তকারীদের কারণ খুঁজে করতে হবে যে এপ্রোচ কন্ট্রোল কর্তৃক প্রতিটি বিমানের জন্য সুনির্দিষ্ট এবং ভিন্ন উচ্চতা নির্ধারণ করে দেয়া সত্বেও কি ভাবে দুটি বিমান একই উচ্চতায় এসে পরস্পরকে আঘাত করে ধংস হয়ে যায়।       

দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্য

Tuesday, June 25, 2013

জার্মানীর আকাশে মধ্যরাতে সংঘর্ষ- ঝরে গেল ৪৮টি উদীয়মান নক্ষত্র- শেষ পর্ব

 






















জার্মানির আকাশে ৩৬০০০ ফিট উপর দিয়ে উড়ছে বাস্কারিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট বিটিসি ২৯৩৭ আর ইতালি থেকে সুইজারল্যান্ডের আকাশে একই উচ্চতায় উড়ে চলেছে আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সংস্থা ডিএইচএল এর ফ্লাইট ডিএইচএক্স ৬১১ঘণ্টায় গড়ে ৯০০ কিলোমিটার বেগে উড়ন্ত এই বিমান দুটি দক্ষিণ জার্মানি ও উত্তর সুইজারল্যান্ড সীমান্তের আকাশে পরস্পরকে অতিক্রম করবে  বাস্কারিয়ান এয়ারলাইন্স বহন করছে মোট ৬৯ জন যাত্রী যাদের মধ্যে ৪৮ জন শিশু কিশোরএরা বাস্কারিয়ান প্রজাতন্ত্র নামক দেশটির অত্যন্ত মেধাবী নবীন নাগরিকডিএইচএল এর বিমানটি বহন করছিল মধ্যপ্রাচ্য এবং ইটালি থেকে সংগ্রহীত কুরিয়ার সামগ্রী এবং দুজন পাইলটএই বিমানটি বাহরাইন থেকে রওয়ানা হয়ে প্রথমে ইটালির বার্গেমো এসে সবশেষে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস এ অবতরণ করবে

রাত ১১:৩৪ মিনিটসুইস বেসরকারি এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল স্কাইগাইডের জুরিখস্থ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রএয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার পিটার নেলসন একাই দুটি মনিটরে প্রদর্শিত বিমানগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেএই মুহূর্তে পিটারের সম্পূর্ণ মনোযোগ এরোলয়েডে এয়ারওয়েজ ফ্লাইট ১১৩৫ এর উপরযাত্রীবাহী এই এয়ারবাসটি নিকটবর্তী  ফ্রিডরিকসহাফেন বিমান বন্দরে অবতরণের জন্য পিটারের সহযোগিতা চাচ্ছেপিটারের সমস্যা হলো, বাস্কারিয়ান এবং ডিএইচএল এর বিমান দুটি প্রদর্শিত হচ্ছে ১ নং মনিটরে এবং এরোলয়েড ফ্লাইটটি দেখা যাচ্ছে ২ নং মনিটরেদুটি মনিটরের মধ্যে প্রায় এক গজের দূরত্বফলে পিটার যখন ১নং মনিটরে মনোযোগ দিচ্ছিল তখন ২নং মনিটরটি অনিয়ন্ত্রিত থাকছিল১নং মনিটর পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে পিটার বুঝতে পারল যে বাস্কারিয়ান ফ্লাইট ২৯৩৭ এবং ডিএইচএল ফ্লাইট ৬১১ একই উচ্চতায় পরস্পরকে লক্ষ্য করে এগিয়ে আসছেএটি একটি কলিশন কোর্স অর্থাৎ বিমান দুটি একই উচ্চতায় থেকে পরস্পরের বিপরীত দিক থেকে এগিয়ে আসতে থাকলে মুখোমুখি সংঘর্ষ হতে পারেপিটার বিষয়টি বুঝতে পেরে সাথে সাথে বাস্কারিয়ান ফ্লাইট ২৯৩৭কে এক হাজার ফুট নীচে অর্থাৎ ৩৫০০০ ফিটে নেমে আসার নির্দেশ দিলএকই সময় এরোলয়েড ফ্লাইট ১১৩৫ এর পাইলট পিটারের কাছে অবতরণ নির্দেশিকা চাইলে পিটার এই ফ্লাইটটিকে সরাসরি ফ্রিডরিকসহাফেন বিমান বন্দরের কন্ট্রোলের কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফোন করতে গিয়ে বুঝতে পারল যে বহির্মুখী ফোন লাইনটি কাজ করছে নাব্যাকআপ ফোনটির সাহায্য নিতে গিয়েও দেখা গেল সেটিও নষ্টবাধ্য হয়েই পিটার এরোলয়েড ফ্লাইটের ক্যাপ্টেনকে সরাসরি ফ্রিডরিকসহাফেন বিমান বন্দরের কন্ট্রোলের সাথে যোগাযোগ করে অবতরণ সহায়তা চাওয়ার পরামর্শ দিলএরই মধ্যে বাস্কারিয়ান ফ্লাইটের টি-ক্যাস যন্ত্রটি ডিএইচএল ফ্লাইটটির উপস্থিতি বুঝতে পেরে কলিশন এলার্ট প্রদান শুরু করেছেবাস্কারিয়ানের পাইলটরা বুঝতে পারছে যে বড় একটি বিমান একই উচ্চতায় থেকে তাদের দিকে এগিয়ে আসছেটি-ক্যাস বলছে ক্লাইম্ব অর্থাৎ মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য উপরে উঠোকয়েক সেকেন্ড পরে ডিএইচএল ফ্লাইটের টি-ক্যাস কলিশন এলার্ট দিয়ে পাইলটকে ডিসেন্ট অর্থাৎ নীচে নামার নির্দেশ দিলএ সময় পিটার এরোলয়েড ফ্লাইটের সাথে কথা বলতে থাকায় ডিএইচএল এর টি-ক্যাস এলার্টটি তার কানে যায় নিডিএইচএল ফ্লাইটটির ক্যাপ্টেন পল ফিলিপ্স টি-ক্যাস এলার্ট শুনে নিয়ম অনুযায়ী এক হাজার ফিট নীচে নামার জন্য বিমানের নাক নিচু করলেনকিন্তু বাস্কারিয়ান ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন অ্যালেক্সান্ডার গ্রস তাঁর বিমানের টি-ক্যাস যন্ত্রটির উপরে উঠার নির্দেশ অগ্রাহ্য করে স্কাইগাইডের কন্ট্রোলার পিটার নেলসনের সহায়তা চাইলেনএরোলয়েড ফ্লাইটটিকে ফ্রিডরিকসহাফেন বিমান বন্দরের কন্ট্রোলের সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়ে পিটার এক নং মনিটরে এসে লক্ষ্য করলো বাস্কারিয়ান ও ডিএইচএল ফ্লাইট দুটি এখনও একই উচ্চতায় রয়েছে, তাই সে বাস্কারিয়ান ফ্লাইটের ক্যাপ্টেনকে অতি দ্রুত নীচে নামার নির্দেশ দিলবাস্কারিয়ান ফ্লাইটের ককপিটে এই মুহূর্তে একটি জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছেটি-ক্যাস বলছে অতি দ্রুত উপরে উঠতে আর স্কাইগাইড থেকে নীচে নামার নির্দেশ দেয়া হয়েছেএকদম শেষ মুহূর্তে পাইলটরা স্কাইগাইডের নির্দেশ মান্য করার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিমানের নাক নিচু করলো ফলে উভয় বিমান আরও দ্রুত পরস্পরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেএরোলয়েড ফ্লাইটটি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার পিটার নেলসন জানতেই পারে নি যে টি-ক্যাসের নির্দেশে ডিএইচএল ফ্লাইটটি ইতোমধ্যেই নীচের দিকে নামা শুরু করেছে। এ ধরনের একটি জটিল মুহুর্তে স্কাইগাইডের আকাশ পথে চলাচলকারী বিমানের উপর লক্ষ্য রাখার মূল রাডারটি বন্ধ থাকায় বিমান দুটোর প্রকৃত উচ্চতা বোঝাও পিটারের পক্ষ্যে সম্ভব ছিল না। এর মধ্যে আরেকটি দূর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটছিল, বিমান বন্দরের আর্লি ওয়ার্নিং সিষ্টেমের দায়ীত্বে থাকা অপারেটর তখন চা পান করার জন্য ক্যাফেটেরিয়াতে গিয়েছিল। ফলে বিমান দুটি সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার দুই মিনিট আগেই আর্লি ওয়ার্নিং সিষ্টেম কলিশন সংকেত প্রদান করলেও তা শোনার জন্য কেউই ছিল না।   

ঠিক রাত ১১:৩৫:৫২ সেকেন্ডে বাস্কারিয়ান ফ্লাইট ২৯৩৭ এবং ডিএইচএল ফ্লাইট ৬১১ আকাশের ৩৪৮৯০ ফিট উচ্চতায় পরস্পরকে ধাক্কা মারলসংঘর্ষের প্রচণ্ডতায় বোয়িং ৭৫৭ বিমানটির টেইল সেকশন এর ভার্টিক্যাল ষ্ট্যাবিলাইজার ছুড়ি দিয়ে যে ভাবে কেক কাটে, সেভাবেই টুপোলভ টিইউ ১৫৪ বিমানটিকে কেটে দুটুকরো করে ফেলেবিমানের ককপিট সহ নোজ সেকশনটি খুব দ্রুত নীচের দিকে পরে যেতে থাকে আর ইন্জিন সহ টেল সেকশন আরও কয়েক সেকেন্ড উড়ন্ত থেকে তারপর ধীরে ধীরে নীচের দিকে নেমে আসেডিএইচএলের বোয়িং ৭৫৭ এর টেল সেকশনের ভার্টিক্যাল ষ্ট্যাবিলাইজারটির প্রায় ৮০% ধংস হয়ে গেলেও বিমানটি আরও ২মিনিট আকাশে ভেসে থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার উড়ে গিয়ে টেইসার্সড্রফ নামের একটি গ্রামের জঙ্গলের উপরে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পরেবাস্কারিয়ান ফ্লাইটের ৬৯ জন এবং ডিএইচএলের ২ পাইলট সহ সবাই তাৎক্ষনিক ভাবে প্রাণ হারালেন

বিমান দুটি সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই পিটার নেলসন বিষয়টি বুঝতে পারেকিন্তু তখন তার কিছুই করার ছিল নাএটি একটি সত্যিকারের দুর্ভাগ্যজনক বিমান দুর্ঘটনা এবং অনেকগুলো অস্বাভাবিক ঘটনা অনাকাংখিতভাবে এক সাথে ঘটার কারনেই বিমান দুটির ভাগ্য বিপর্যয় ঘটেছিল

দুর্ঘটনা পর পরই বাহরাইন, রাশিয়া এবং জার্মানির বিমান দুর্ঘটনা তদন্ত সংস্থাগুলো বিভিন্নভাবে তদন্ত করে দুর্ঘটনার কারনগুলো খুঁজে বেড় করেএতে সবাই একমত হয় যে সুইজারল্যান্ডের বেসরকারি এয়ার ট্রাফিক সংস্থা স্কাইগাইডের দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও লোক স্বল্পতাই দুর্ঘটনাটির প্রধান কারনএ ছাড়া বাস্কারিয়ান ফ্লাইটটির পাইলটদের টি-ক্যাস যন্ত্রের নির্দেশ অমান্য করে নীচের দিকে নামাটিও আরেকটি প্রধান কারন

দুর্ঘটনার পরে পিটার নেলসন চাকুরী ছেড়ে দিয়ে অজ্ঞাতবাসে চলে যায় তবে ২০০৪ সনের ২৪ ফেব্রুয়ারি জুরিখের নিকটবর্তী ক্লোটেন নামক স্থানে রাশিয়ান স্থপতি ভিটালী কলোয়েভ এর ছুরিকাঘাতে নিহত হয়বিমান দুর্ঘটনা তাঁর পরিবারের সকল সদস্যের মৃত্যুর জন্য ভিটালী পিটারকে দায়ী মনে করতেনএই হত্যাকাণ্ডের জন্য ভিটালীকে কারাদণ্ড দেয়া হলেও তাঁর মানসিক অবস্থার কথা বিবেচনায় এনে ২০০৭ সনে তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়

বাস্কারিয়ান ফ্লাইট ২৯৩৭ এবং ডিএইচএল ফ্লাইট ৬১১ এর মুখোমুখি সংঘর্ষের ফলে নিহতদের স্মরণে জার্মান সরকার ইউবারলিনজেন গ্রামে একটি স্মৃতিসৌধ তৈরি করেছেদুর্ঘটনায় নিহত ৭১ জন অকাল প্রয়াত মানুষের নিকট আত্মীয়রা ছিন্ন হওয়া মুক্তার মালার আকৃতির এই স্মৃতি সৌধটিতে প্রতি বছর ১লা জুলাই তারিখে শোকতপ্ত মনে আসেন দুর্ভাগা মানুষগুলোর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেআর নিহত ৪৮ জন মেধাবী শিশু কিশোরদের মাতৃভূমি বাস্কারিস্থানের মানুষরা প্রতি বছর এই দিনে অনেক শ্নেহ আর ভালবাসার সাথে স্মরণ করেন তাঁদের অকালে হাড়িয়ে যাওয়া সন্তানদের

Wednesday, June 12, 2013

জার্মানীর আকাশে মধ্যরাতে সংঘর্ষ- ঝরে গেল ৪৮টি উদীয়মান নক্ষত্র- প্রথম পর্ব




২৮শে জুন ২০০২। সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়নের অংশ এবং বর্তমানে প্রজাতন্ত্র বাশকারিস্থানের রাজধানী উফার কেন্দ্রীয় ট্রেন ষ্টেশন। আজ সকাল থেকেই এখানে উৎসব ভাব। বাবা, মা, ভাই, বোন সহ একে একে উপস্থিত হচ্ছে উফার ক্ষুদে নক্ষত্ররা। ইউনেস্কোর আমন্ত্রনে উফার ৪৮ জন মেধাবী শিশু কিশোর আজ মস্কো হয়ে স্পেনের অবকাশ কেন্দ্র বার্সেলোনা যাবে। ক’জন শিক্ষক শিক্ষিকার সাথে এই শিশুরা ট্রেনে করে প্রথমে রাশিয়ান ফেডারেশনের রাজধানী মস্কো যাবে। সেখান থেকে ১১ ঘন্টা বিমান ভ্রমন শেষে বোর্সেলোনা পৌছে দু সপ্তাহের ছুটি কাটাবে। তারপর আবার ফিরে আসবে তাদের একান্ত আপন উফায়। এই সব শিশুদের কেউ ছবি আকে, কেউ অত্যন্ত নামকরা ক্রিড়াবীদ। এদের প্রতিভায় মূগ্ধ হয়ে জাতিসংঘের শিক্ষা ও সাংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো বার্সেলোনায় এই অবকাশের আয়োজন করেছে। ঠিক কাটায় কাটায় সকাল এগারোটায় মস্কোর উদ্দেশ্যে ট্রেন ছাড়লো। ক্ষুদে প্রতিভাদের সাথে দুই শিশু সহ একজন অতিথিও আছেন। তিনি হলেন লুদমিলা কলোয়েভ, উফার বিখ্যাত স্থপতি ভিটালী কলোয়েভের স্ত্রী। ভিটালী বিশেষ কাজে বার্সেলোনার কাছেই এক স্থানে আছেন তাই দুই সন্তান নিয়ে লুদমিলা উফার বিশিষ্ট শিশুদের সাথে বার্সেলোনা যাচ্ছেন স্বামীর সাথে ছুটি কাটাতে।
 
চার ঘন্টা পরে ট্রেন মস্কো পৌছলে ষ্টেশনে অপেক্ষারত ট্যুরিষ্ট এজেন্ট সবাইকে দুটি বাসে করে মস্কোর এক প্রান্তের শেরমেতিয়েভো বিমান বন্দরে নিয়ে এল। এজেন্টের ধারনা ছিল বার্সেলোনাগামী বিমানটি এখান থেকে ছাড়বে। কিন্তু সবাইকে নিয়ে বিমানবন্দরে ঢোকার পর জানা গেল বার্সেলোনাগামী বিমানের জন্য নির্ধারিত বিমানবন্দর হলো দোমোদেদোভো যেটি মস্কোর আরেক প্রান্তে অবস্থিত। ভূলটি জানার পর ট্র্যাভেল এজেন্ট তা সংশোধনের আপ্রাণ চেষ্টা করলেও কোন হল না। শিশুরা তাদের জন্য নির্ধারিত বার্সেলোনাগামী বিমানটিতে উঠতে ব্যার্থ হলেও তারা যাতে মন খারাপ না করে সে জন্য ট্যুরিষ্ট এজেন্সীটি মস্কোতেই তাদেরকে বিভিন্ন দর্শনীয় জায়গা পরিদর্শনের ব্যবস্থা করলো। একই সাথে নতুন আরেকটি বিমান চার্টারের চেষ্টা চললো। দু’দিন পর, অর্থাৎ ১লা জুন ২০০২, বাস্কারিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি বিমান চার্টার করা সম্ভব হ’ল।
 
১লা জুলাই ২০০২, রাত ১০:৪৫, মস্কো দোমোদেদোভো আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। রানওয়েতে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের অনুমতির জন্য অপেক্ষা করছে বাম্কারিয়ান এয়ার লাইন্সের ফ্লাইট ২৯৩৭। এই ফ্লাইটে ব্যবহৃত হবে টুপলভ ১৫৪ বিমান। রাশিয়ায় তৈরী এই বিমান যথেষ্ট নিরাপদ এবং স্বল্প পাল্লার উড়ানের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। আজকের ফ্লাইটে মোট ৫ জন ককপিট ক্রু বিমানটি পরিচালনা করবেন। তবে তিন জন পাইলট মূলত: বিমানটি চালিয়ে নিয়ে যাবেন বার্সেলোনা পর্যন্ত। আজকের ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন হলেন আলেক্সান্ডার গ্রস। প্রায় ত্রিশ বছর ধরে তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বিমান চালাচ্ছেন। তাঁর কো-পাইলট হিসেবে আছেন ওলেগ গ্রিগারয়েভ। প্রকৃতপক্ষে ওলেগ হচ্ছেন বাস্কারিয়ান এয়ালাইন্সের প্রধান পাইলট। আজকের ফ্লাইটে তিনি আছেন একজন পর্যবেক্ষক ও মূল্যায়নকারী হিসেবে।  আজ তিনি ক্যাপ্টেন গ্রোসের বিমান চালনা পর্যবেক্ষন করবেন। পেছনের সীটে বসেছেন আজকের ফ্লাইটের মূল কো-পাইলট বা ফার্ষ্ট অফিসার মুরাদ ইক্রিয়ভ। মুরাদও অত্যন্ত দক্ষ একজন পাইলট এবং খুব তারাতারি ক্যাপ্টেন হিসেবে পদন্নোতি ঘটতে যাচ্ছে তার। এছাড়া বিমানে উপস্থিত আছেন একজন দক্ষ নেভিগেটর ও একজন ফ্লাইট ইন্জিনিয়ার।
 
রাত ১১টা বাজার পাঁচ মিনিট আগে দোমোদেদোভো ফ্লাইট কন্ট্রোল অনুমতি দিলে ফ্লাইট ২৯৩৭ স্পেনের বার্সেলোনার উদ্দেশ্যে রানওয়ে ত্যাগ করলো। ককপিট ও কেবিন ক্রু সহ বিমানটির মোট যাত্রী ৬৯। আশা করা যায় মোট চার ঘন্টা চল্লিশ মিনিট উড়ার পর ২রা জুলাই ভোর ১:৩০ এর মধ্যে বিমানটি বার্সেলোনার এল প্র্যাট ডি লোবরিগ্যাট বিমান বন্দরে অবতরন করবে। মস্কোর সাথে বার্সেলোনার সময়ের পার্থক্য -২ ঘন্টা।
 
বাস্কারিয়ান ফ্লাইট ২৯৩৭ দোমোদেদোভো ত্যাগ করার দু ঘন্টা পর অর্থাৎ স্থানীয় সময় রাত ১১:০৬ এ ইটালীর বার্গেমো বিমান বন্দর থেকে একটি বোয়িং ৭৫৭ বিমান বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেল্সের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল। আন্তর্জাতিক ক্যুরিয়ার সংস্থা ডিএইচএল এর হয়ে বিমানটি মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন শহর থেকে পণ্য ও ডাক পরিবহন করে। আজকের ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন পল ফিলিপ্স ফ্লাইটের প্রথম অংশটি পরিচালনা করবেন এবং ফার্ষ্ট অফিসার ব্র্যান্ড ক্যাম্পিউনি পরিচালনা করবেন দ্বিতীয় অংশ। ইটালী সময় রাত ১১:০৬ মিনিটে ডিএইচএল ফ্লাইট ডিএইচএক্স ৬১১ রানওয়ে ত্যাগ করে ব্রাসেল্সের উদ্দেশ্যে উড়াল দিল। বিমানটি ইটালীর আকাশ থেকে প্রথমে সুইজারল্যান্ডের আকাশে প্রবেশ করবে। তার যাত্রার এই অংশটি নিয়ন্ত্রন করবে সুইস বেসরকারী এয়ার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রনকারী সংস্থা স্কাই গাইড। সুইজারল্যান্ডের আকাশ সীমা পাড় হয়ে বিমানটি প্রবেশ করবে জার্মানীর আকাশে এবং তখন নিয়ন্ত্রন গ্রহন করবে জার্মান এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল। বাস্কারিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট বিটিসি ২৯৩৭ স্পেনের পথে উড়তে গিয়ে দক্ষিন জার্মানীর আকাশে ডিএইচএল ফ্লাইটটিকে অতিক্রম করবে। তবে দুটি বিমানের এ ধরনের অতিক্রম মোটেও বিপদজনক নয় এমনকি বিমান দুটি একই উচ্চতায় থাকলেও কোন ভয় নেই। ট্যুপোলেভ ১৫৪ এবং বোয়িং ৭৫৭, উভয়ই অত্যন্ত আধুনিক বিমান। দুটোতেই সংঘর্ষ এড়ানোর যন্ত্র টি-ক্যাস সংযুক্ত রয়েছে। আকাশে উড়ন্ত অবস্থায় দুটো বিমান পরষ্পরের খুব কাছাকাছি এসে গেলে টি-ক্যাস বা ট্রাফিক কলিশন এভয়ডেন্স সিষ্টেম বিপদ সংকেত প্রদান করে এবং বিমাদ্বয়ের পাইলটদের এ ধরনের পরিস্থিতিতে করনীয় বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করে।  
 
সুইস সময় সন্ধ্যা ৭:৫০। বেসরকারী এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল স্কাইগাইডের জুরিখ কেন্দ্র। স্কাই গাইডের জুরিখস্থ এরিয়া কন্ট্রোল সেন্টার উত্তর সুইজারল্যান্ড ও দক্ষিন জার্মানীর আকাশে বিমানের চলাচল নিয়ন্ত্রন করে। দিনের অতি ব্যাস্ত শীফ্ট সবে মাত্র শেষ হয়েছে। রাতের শীফ্টের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার পিটার নেলসন তার দায়ীত্ব বুঝে নিতে এলো। পিটার একজন ভাল কন্ট্রোলার হিসেবে পরিচিত এবং আট বছরের অভিজ্ঞতা তাকে একজন দক্ষ এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার হিসেবে গড়ে তুলেছে। সুইজারল্যান্ডের আকাশ দিনের বেলা অতি ব্যাস্ত থাকে। তাই দিনের শীফ্টে দুজন কন্ট্রোলার কাজ করে। রাতের শীফ্টে আকাশে বিমানের সংখ্যা কম থাকায় দু’জন কন্ট্রোলার পালাক্রমে কাজ করে। অর্থাৎ আকাশে উড্ডয়নরত বিমান পর্যবেক্ষনকারী রাডার এবং ২টি মনিটরের মাধ্যমে বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রনের দায়ীত্ব থাকে একজনের উপর, অপরজন তখন বিশ্রাম নেয়। একজন সহকারী নিয়ে পিটার নেলসন দায়ীত্ব গ্রহন করলে দ্বিতীয় কন্ট্রোলার বিশ্রামে গেল। এখন থেকে পিটার নেলসনকেই পালাক্রমে দুটি মনিটরের উপর দৃষ্টি রাখতে হবে এবং আকাশ পথের বিমানগুলোর পাইলটদের সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে। এতে করে পিটারের কাজের চাপ অনেক বেড়ে যাবে। এই নিয়মটি যদিও আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল আইনের পরিপন্থি কিন্তু বেসরকারী সুইস স্কাইগাইড এর অপারেটররা দীর্ঘদিন ধরেই এই ব্যবস্থা অনুসরন করে আসছে।
 
রাত ১১:১০। কাজের চাপ কম থাকায় পিটার একাই দুটি মনিটরের মাধ্যমে বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রন করছে। দুটি মনিটর এমন দুরত্বে অবস্থিত যে একটির দিকে নজর দিলে অন্যটি দেখা সম্ভব হয় না। তবে আকাশে বিমান চলাচল কম থাকায় কোন সমস্যা হচ্ছে না। এমন সময় নিয়ন্ত্রন কক্ষে দুজন টেকনিশিয়ান প্রবেশ করলো। স্কাইগাইড কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তারা বিমান চলাচল পর্যবেক্ষনকারী মূল রাডারে কিছু রক্ষনাবেক্ষন কাজ করবে। এতে করে রাডারের গতি ধীর হয়ে যাওয়ায় পিটারের কাজের চাপ আরও বাড়বে। এছাড়া, দুটি বিমানের দূরত্ব কমে গিয়ে মূখোমূখী সংঘর্ষের সম্ভাবনা দেখা দিলে রাডার থেকে দুমিনিট প্রেরিত বিপদ সংকেতও এ সময় শোনা যাবে না। আধ ঘন্টা পর টেকনিশিয়ানদ্বয় এসে জানালো যে রক্ষনাবেক্ষন কাজের অংশ হিসেবে তারা এবার নিয়ন্ত্রন কক্ষের মূল টেলিফোন লাইনটি বিচ্ছিন্ন করবে। পিটারের প্রচন্ড আপত্তি থাকা সত্বেও টেলিফোন লাইনটি বিচ্ছিন্ন করা হল। এখন থেকে বাইরের লাইনে কথা বলার জন্য পিটারকে বিকল্প ব্যাক আপ টেলিফোন সিষ্টেমের উপর নির্ভর করতে হবে যদিও ব্যাক আপ সিষ্টেমটি প্রায়ই নষ্ট থাকে। ঠিক এই সময় জুরিখ এরিয়া কন্ট্রোল সেন্ট্রাল নিয়ন্ত্রিত আকাশ সীমায় একই সাথে প্রবেশ করলো মোট তিনটি বিমান, দুটি যাত্রীবাহী এবং অপরটি পণ্যবাহী। এরোলয়েডে এয়ারওয়েজ ফ্লাইট ১১৩৫, একটি যাত্রীবাহী এয়ারবাস নিকটবর্তী ফ্রিডরিকসহাফেন বিমান বন্দরে অবতরন করবে, জার্মান এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল কর্তৃক হস্তান্তরিত বাস্কারিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট বিটিসি ২৯৩৭ এবং ইটালীরে আকাশ থেকে সুইস আকাশে প্রবেশ করা ডিএইচএল ফ্লাইট ডিএইচএক্স ৬১১। তিনটি বিমানের সাথেই পিটারের যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। এরোলয়েড ফ্লাইট ফ্রিডরেকসহাফেন বিমান বন্দরে অবতরনে সহায়তা চাইলো। অপরদিকে ডিএইচএল ফ্লাইট ২৬০০০ ফিট থেকে প্রথমে ৩২০০০ ফিট এবং সবশেষে ৩৬০০০ ফিট উচ্চতায় উড়ার অনুমতি চাইলো এবং বাস্কারিয়ান ফ্লাইট ৩৬০০০ ফিট উচ্চতায় থেকে বার্সেলোনার দিকে উড়ে যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করলো। এই পর্যায়ে ১নং মনিটর থেকে পিটার নিয়ন্ত্রন করবে বাস্কারিয়ান ও ডিএইচএল ফ্লাইট এবং ২নং মনিটর থেকে এরোলয়েড ফ্লাইটের অবতরন নিয়ন্ত্রিত হবে ।   
 
উর্ধাকাশে উড্ডয়নরত দুটি বিমান নিয়ন্ত্রনকালে অপর একটি বিমান অবতরনে সহায়তা করা অত্যন্ত জটিল ও কঠিন কাজ বিধায় পিটার এরোলয়েড ফ্লাইটটিকে ফ্রিডরিকসহাফেন বিমান বন্দরের টাওয়ার কন্ট্রোলের কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফোন করার চেষ্টা ব্যর্থ হলো। মূল টেলিফোন লাইন ইতোমধ্যে রক্ষনাবেক্ষনের জন্য বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে এবং ব্যাক আপ সিষ্টেমটি যথারীতি কাজ করছে না। ফ্রিডরিকসহাফেন টাওয়ার কন্ট্রোলের সাথে যোগাযোগে ব্যর্থ হয়ে পিটার এরোলয়েড ফ্লাইটিকে অবতরনে সহযোগীতা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে একই সাথে তিনটি কাজ করলো। ডিএইচএল ফ্লাইটিকে ৩৬০০০ ফিট উপরে উঠে যাওয়ার অনুমতি দিল, বাস্কারিয়ান ফ্লাইটটিকে ৩৬০০০ ফিট উচ্চতায় থেকে বার্সেলোনার দিয়ে এগিয়ে যেতে বললো এবং এরোলয়েড ফ্লাইটটিকে ফ্রিডরিকসহাফেন বিমান বন্দরে অবতরনের জন্য লাইন আপে আসার নির্দেশ প্রদান করলো। কেউই বুঝতে পারলো না, পিটারের এই কাজগুলোর কারনে এই মাত্র ধংসের এক মহা বীজ বপন করা হল যার ফলস্রুতিতে ঝরে যাবে ৬৯টি অমূল্য প্রাণ।
 
জার্মানীর আকাশে ৩৬০০০ ফিট উপর দিয়ে উড়ছে বাস্কারিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট বিটিসি ২৯৩৭, ইটালী থেকে সুইস আকাশে একই উচ্চতায় উড়ে চলেছে আন্তর্জাতিক ক্যুরিয়ার সংস্থা ডিএইচএল এর ফ্লাইট ডিএইচএক্স ৬১১। ঘন্টায় গড়ে ৯০০ কিলোমিটার বেগে উড়ন্ত এই বিমান দুটি দক্ষিন জার্মানী ও উত্তর সুইজারল্যান্ড সীমান্তের ইউবারলিন্জেন এবং ওইলিন্জেন শহর দুটোর আকাশে পরষ্পরকে অতিক্রম করবে। 

 
দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্ত


Saturday, June 8, 2013

আটলান্টিকে হাড়িয়ে গেল এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইট এএফ ৪৪৭- শেষ পর্ব

 

১লা  জুন ২০০৯। মধ্য আটলান্টিকের ঝন্জা বিক্ষুদ্ধ আকাশ পথে উড্ডয়নরত অবস্থায় হাড়িয়ে গেছে বিশ্বের বৃহৎ বিমান পরিবহন সংস্থা এয়ার ফ্রান্সের ফ্লাইট এএফ ৪৪৭। অত্যাধুনিক সুপরিসর এয়ারবাস এ ৩৩০-২০০ বিমান যোগে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো থেকে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস যাচ্ছিলেন ২১৬ জন যাত্রী এবং ১২ জন ক্রু। ব্রাজিল সময় ৩১শে মে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় বিমানটি প্যারিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। কোঅর্ডিনেটেড ইউনিভার্সাল টাইম ১লা জুন ভোর ১:৪৮ মিনিটে বিমানটি মধ্য আটলান্টিকের কমিউনিকেশন ডেড জোনে প্রবেশ করে। দু ঘন্টা পর সেনেগালের ডাকার এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের একজন অপারেটর ফ্লাইট এএফ ৪৪৭ এর সাথে রেডিও যোগাযোগের চেষ্টা করলে জানা যায় যে বিমানটি নিখোঁজ হয়েছে। ফ্লাইট ৪৪৭ এর নিখোঁজ হওয়ার সংবাদে সমগ্র বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং ব্রাজিল, ফ্রান্স, স্পেন ও যুক্তরাষ্ট্র একসাথে অনুসন্ধান অভিযান শুরু করে। ২রা জুন ২০০৯ অপরান্হে, ব্রাজিলিয় বিমান বাহিনীর একটি এমব্রায়ার বিমান  ফ্লাইট ৪৪৭ এর সর্বশেষ অবস্থানের উপর অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে একটি বিমানের কিছু ধংসাবশেষ খুঁজে পায়। ২রা জুন বিকেলে ব্রাজিল সরকার ফ্লাইট এএফ ৪৪৭ এর দুর্ঘটনার সংবাদটি প্রকাশ করে।

ফ্লাইট ৪৪৭ নিখোঁজ হওয়ার পর ১লা জুন সকালে ব্রাজিলিয় বিমান বাহিনীর বেশ ক’টি বিমান অনুসন্ধানে যোগ দেয়। এরই একটি এমব্রায়ার আর ৯৯- এ বিমান ফারনান্দো ডি নরনহো দ্বীপান্চলের প্রায় ৬৫০ কিলোমিটার উত্তর পূর্ব এলাকায় সমূদ্রে ভাসমাণ অবস্থায় একটি বিমানের সামান্য কিছু ধংসাবশেষ খুঁজে পায়। এর মধ্যে ছিল একটি সীট, প্যাকেটকৃত অবস্থায় কয়েকটি লাইফ জ্যাকেট, একটি বয়া ইত্যাদি। ধংসাবশেষ পরীক্ষা করে জানা যায় এগুলো ফ্লাইট ৪৪৭ এরই অংশ।

ফ্লাইট ৪৪৭ নিখোঁজ হওয়ার পর ফ্রান্স সরকার এর রহস্য অনুসন্ধানের দায়ীত্ব দেয় ফ্রান্সের তদন্ত ও বিশ্লেষন ব্যুরো (বিইএ) উপর।  বিইএ’র প্রধান পল লুই আরসলানিয়নের নের্তৃত্বে বিইএ অনতিবিলম্বে তদন্ত শুরু করে।

২রা জুন দুপুরে ফরাসী নৌ বাহিনীর ফ্রীগেট ভেনটোস এবং হেলিকপ্টার বাহী জাহাজ মিষ্ট্রেল আটলান্টিকের সম্ভাব্য দুর্ঘটনাস্থলে ব্যপক তল্লাশী চালানোর জন্য রওয়ানা দেয়। ফরাসী সামুদ্রিক গবেষণা জাহাজ পরকুই পাসও এই অনুসন্ধানে অংশগ্রহন করে। এই জাহাজে সমুদ্রের তলায় অনুসন্ধান উপযোগী দুইটি মিনি সাবমেরিন ছিল। ধারনা করা হচ্ছিল দুর্ঘটনাস্থলে আটলান্টিকের গভিীরতা প্রায় ১৬০০০ ফিট এর মত হবে।

৩রা জুন ব্রাজিলিয় নৌ বাহিনীর পাঁচটি জাহাজ ফ্লাইট ৪৪৭ এর খোঁজে দুর্ঘটনাস্থলে পৌছে। ব্রাজিলিয়ান নৌ বাহিনী ও বিমান বাহিনীর যৌথ অনুসন্ধানের মাধ্যমে  ৬ই জুন  ফ্লাইট ৪৪৭ এর কজন যাত্রীর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এ সময় দুর্ঘটনা কবলিত বিমানের যাত্রীদের ভাসমান মৃতদেহের পাশ থেকে  ল্যাপটপ সহ একটি ব্যাকপ্যাক, একটি ব্রীফ কেস ইত্যাদি উদ্ধার করা হয়।

৭ই জুন অনুসন্ধানকারীরা ধংসপ্রাপ্ত বিমানের ভার্টিক্যাল ষ্ট্যাবিলাইজারটি উদ্ধার করেন। এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ন উদ্ধার কারন ভার্টিক্যাল ষ্ট্যাবিলাইজার পরীক্ষা করে বিমান দূর্ঘটনা বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা কিছুটা ধারনা করতে পারবেন। ১৭ই জুনের মধ্যে ব্রাজিলিয় এবং ফরাসী উদ্ধারকর্মীরা ৫০টি মৃতদেহ এবং ভেঙ্গে পরা বিমানের ৪০০টি ক্ষুদ্র অংশ উদ্ধার করেন। এ সময় বিমানের ক্যাপ্টেন মার্ক দ্যুবোয়া’র মৃতদেহ উদ্ধার করে ব্রাজিলিয় নৌ বাহিনী। ২৫শে জুন ব্রাজিল, ফ্রান্স, স্পেন ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ উদ্যোগে  সুমদ্রের উপর অংশে পরিচালিত উদ্ধার অভিযানের সমাপ্তি ঘোষনা করা হয়। কিন্তু হাড়িয়ে যাওয়া বিমানের ধংসাবশেষের খোঁজে সমদ্রের নীচে উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রাখা হয়। এ সময় বিমানের দুইটি ব্ল্যাক বক্স; ফ্লাইট ড্যাটা রেকর্ডার বা এফডিআর এবং ককপিট ভয়েস রেকর্ডার বা সিভিআর উদ্ধারের উপর সবচাইতে বেশী গুরুত্ব প্রদান করা হয়। এই গুরুত্বপূর্ন উদ্ধার কাজ পরিচালনার জন্য ফরাসী নৌ বাহিনী একটি পারমানবিক সাবমেরিন দুর্ঘটনাস্থলে প্রেরন করে।

এফডিআর এবং সিভিআর যে কোন যাত্রীবাহী বিমানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন দুইটি যন্ত্রাংশ। এফডিআর বা ফ্লাইট ড্যাটা রেকর্ডার বিমান চলাচল সংক্রান্ত সবধরনের তথ্য সংরক্ষন করে আর ককপিট ভয়েস রেকর্ডার বা সিভিআর বিমানের ককপিটের সমস্ত কথোপকথন যেমন ককপিটে অবস্থিত ক্রুদের মধ্যে কথাবার্তা অথবা ককপিট ক্রুদের সাথে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের কথোপকথন ইত্যাদি রেকর্ড করে রাখে। সাধারনত শেষ দুই ঘন্টার কথোপকথনের রেকর্ড থাকে সিভিআরএ। একটি বিমান দুর্ঘটনায় পরলে তদন্তকারীরা এফডিআর ও সিভিআর এর তথ্য সমূহ বিশ্লেষন করে দূর্ঘটনার কারন জানার চেষ্টা করেন। এফডিআর ও সিভিআরকে ব্ল্যাক বক্স বলা হলেও এগুলো উজ্জল কমলা রংএর হয় এবং পানি ও আগুন প্রতিরোধক কেসিংএর ভেতরে থাকে বিধায় দুর্ঘটনার সময় আগুন অথবা পানিতে এগুলো নষ্ট হয় না। এ ছাড়া, ব্ল্যাক বক্সে ইলেকট্রিক সিগন্যাল প্রদানকারী বিকন বসানো থাকে। এই বিকন দূর্ঘটনার পরবর্তী ৩০ দিন সিগন্যাল পাঠায় যাতে উদ্ধার কর্মীরা বিকন অনুসরন করে ব্ল্যাক বক্স দুটোকে খুঁজে পেতে পারে।এমনকি সমুদ্রের ৩ মাইল নীচ থেকে প্রেরিত  বিকন সিগনাল গ্রহন করে ব্ল্যাক বক্সের অবস্থান সনাক্ত করা সম্ভব। কিন্তু ব্ল্যাক বক্স উদ্ধারে ফরাসী এবং ব্রাজিলিয়ান নৌবাহিনীর সব ধরনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এফডিআর এবং সিভিআর উদ্ধার না হওয়ায় ফ্লাইট ৪৪৭ এর দূর্ঘটনার রহস্যটি অমিমাংসিত রয়ে যায়। তবে জুলাই মাসে ফরাসী অনুসন্ধান দল সমূদ্রের অনেক নীচ থেকে অত্যন্ত দূর্বল একটি বিকন সংকেত পেয়েছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে তা অস্বীকার করা হয়।

ইতোমধ্যে ফ্রান্সের তদন্ত ও বিশ্লেষন ব্যুরো (বিইএ) উদ্ধারকৃত বিমানের অংশ পরীক্ষা করে একটি বিষ্ময়কর তথ্য উদ্ঘাটন করে। বিশ্লেষকরা বিমানের কয়েকটি অংশ পরীক্ষা করে জানতে পারেন যে  আকাশ থেকে পতনের সময়  বিমানটি প্রচন্ড বেগে সমূদ্রে নেমে আসে। সাধারনত, যে কোন বিমান দূর্ঘটনার ক্ষেত্রে বিমানটি নোজ ডাইভ দিয়ে মাটিতে বা পানিতে নেমে আসে অর্থাৎ বিমান আকাশ থেকে খাড়াভাবে পরে যায়। কিন্তু ফ্লাইট ৪৪৭ এর ক্ষেত্রে এমনটি হয় নি। বিশ্লেষকরা দেখেন যে বিমানটি একই সাথে প্রচন্ড বেগে সামনের দিকে এগিয়েছে এবং খুব দ্রুত উচ্চতা হাড়িয়ে সমূদ্রে পরে গেছে।  এটি সত্যিই একটি অস্বাভাবিক দূর্ঘটনা। বিইএ’র অনুসন্ধানী দল বিমানটি থেকে প্রেরিত ২৪টি অ্যাকারস বার্তা পরীক্ষা করে জানতে পারে যে সর্বশেষ বার্তায় বিমানের পিটো টিউব এ ত্রুটি বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ দুর্ঘটনার সময় বিমানের একাধিক পিটোটিউব কাজ করছিল না। পিটো টিউব হচ্ছে বিমানের সম্মুখভাগে অবস্থিত ছিদ্রযুক্ত টিউব আকৃতির যন্ত্র। বিমান চলার সময় ছিদ্র দিয়ে বাতাস প্রবেশ করে গতি নির্দেশক কাটাটিকে ঘুড়িয়ে বিমানের গতিবেগ প্রকাশ করে। পিটো টিউব কাজ না করলে হয়তো বিমানের গতি জানা যাবে না কিন্তু এই ধরনের সমস্যায় দুর্ঘটনা ঘটার কোন সম্ভাবনাই নেই। বিশ্লেষকরা আরও জানতে পারে যে এক পর্যায়ে বিমানের অটো পাইলট বন্ধ হয়ে যায় এবং পাইলটরা বিমানের নিয়ন্ত্রন গ্রহন করেন। প্রাপ্ত তথ্যগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন হলেও এ থেকে দুর্ঘটনা সম্বন্ধে কোন চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব ছিল না।

১লা জুন ২০০৯ দুর্ঘটনা ঘটার পর থেকে মার্চ ২০১১ পর্যন্ত  ফ্রান্স, ব্রাজিল এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উদ্যেগে অসংখ্য অনুসন্ধান অভিযান পরিচালিত হয় ফ্লাইট ৪৪৭ এর ধংসাবশেষের খোঁজে এবং সবগুলোই ব্যার্থ হয়। এ সময় আটলান্টিক মহাসাগরের নীচে প্রায় ২২০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় অনুসন্ধান চালানো হয়। এই ব্যর্থতার কারনে ফ্রান্স সরকার অনুসন্ধান বন্ধ করে দিতে চাইলেও নিহত যাত্রী ও ক্রুদের আত্নীয় স্বজনের চাপে সরকার ২০১১ এর মার্চ মাসে বেসরকারী সামুদ্রিক উদ্ধার প্রতিষ্ঠান উডস ওসেনোগ্রাফিক ইনষ্টিটিউশনের সহায়তা গ্রহন করে এবং চতুর্থ পর্বের অনুসন্ধান অভিযান শুরু হয়। এপ্রিলের প্রথম থেকে এই ইনষ্টিটিউশন অত্যাধুনিক অটোনোমাস আন্ডারওয়াটার ভেহিক্যালের সহায়তায় সমুদ্রের নীচে ব্যপক অনুসন্ধান চালায় এবং ৩রা এপ্রিল ২০১১ তারিখ সকালে সমুদ্রের ১৩০০০ ফুট নীচে ফ্লাইট ৪৪৭ এর ধংসাবশেষ অবিষ্কার করে। পানির নীচে তোলা ডিজিটাল আলোকচিত্রে দেখা যায় বিমানটি ৬০০ থেকে ২০০০ ফুট জায়গা জুড়ে রয়েছে। এ থেকে ধারনা করা হয় সমূদ্রে তলিয়ে যাওয়ার সময় বিমানটি একেবারে ভেঙ্গে চূর্ন বিচূর্ন হয়ে যায় নি। সুতরাং বোমা বিষ্ফোরন অথবা ঝড়ের কারনে যে বিমানটি ধংস হয় নি এ বিষয়টি ষ্পষ্ট হয়। ফ্রান্স সরকার যুক্তরাষ্ট্রের ফিনিক্স ইন্টারন্যাশনাল নামক সংস্থাটিকে উদ্ধারকর্ম পরিচালনার দায়ীত্ব দেয়। সমূদ্রের নীচ থেকে উদ্ধারকর্ম পরিচালনার ক্ষেত্রে ফিনিক্স অত্যন্ত পারদর্শী এবং এই প্রতিষ্ঠানটিই সমূদ্রের নীচ থেকে টাইটানিক জাহাজ উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করেছিল। ২৬শে এপ্রিল ২০১১ তারিখে ফিনিক্সের কর্মীরা ফ্লাইট ৪৪৭ এর ককপিট ভয়েস রেকর্ডার ও ফ্লাইট ড্যাটা রেকর্ডার উদ্ধার করে প্যারিস প্রেরন করে। একই সাথে বিমানের ধংসাবশেষে থাকা নিহত যাত্রীদের মরদেহও উদ্ধার করা হয়। ফ্লাইট ৪৪৭ এর ২২৮ জন যাত্রী ও ক্রুদের মধ্যে মোট ১০৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়।

বিইএ’র বিশ্লেষকরা ১৬ই মে ২০১১ তারিখের মধ্যে সিভিআর ও এফডিআর ড্যাটা পরীক্ষা শুরু করেন এবং  ২০শে মে’র মধ্যে ফ্লাইট ৪৭৭ এর দূর্ঘটনার রহস্য ভেদ করা সম্ভব হয়। ২৭শে মে ২০১১ তারিখে ফ্রান্সের তদন্ত ও বিশ্লেষন ব্যুরো (বিইএ) এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইট এএফ ৪৪৭ এর দূর্ঘটনার পূর্নাঙ্গ প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন সরকারীভাবে প্রকাশ করে।

কি ঘটেছিল ফ্লাইট এএফ ৪৪৭ এ?

ক্যাপ্টেন মার্ক দ্যুবোয়া’র কমান্ডে ফ্লাইট ৪৪৭ ব্রাজিল সময় সন্ধ্যা ৭:২৯ এ রানওয়ে ত্যাগ করে আকাশে উঠে আসে। এ সময় বিমানের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে ডান দিকের আসনে বসে ছিলেন ফার্ষ্ট অফিসার পিয়েরে সেড্রিক বুনাঁ। ফার্ষ্ট অফিসার ডেভিট রবার্ট বা ডেভ রব্যা ক্রুদের বিশ্রামস্থলে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। ক্যাপ্টেন মার্ক দ্যুবোয়া  এয়ার ফ্রান্সের একজন অতি মুল্যবান পাইলটদের একজন ছিলেন। তাঁর জীবনের অর্ধেক সময় ধরেই তিনি বিমান চালিয়েছেন। ফার্ষ্ট অফিসার পিয়েরে সেড্রিক বুনাঁও একজন অভিজ্ঞ পাইলট ছিলেন। এয়ারবাস এ ৩৩০ চালানোর ক্ষেত্রে তাঁর এক বৎসরের অভিজ্ঞতা ছিল। ফার্ষ্ট অফিসার ডেভ রব্যা এক বছরের কিছু বেশী সময় ধরে এয়ারবাস এ ৩৩০ পরিচালনা করেছেন। ইউটিসি সময় ভোর ১:৪৮ মিনিটে ব্রাজিলিয়ান এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল ফ্লাইট ৪৪৭ কে আটলান্টিক সেন্টারের সাথে যোগাযোগের নির্দেশ দেয়। দক্ষিন আটলান্টিক মহাসাগরের উপর দিয়ে চলাচলকারী সব ধরনের বাণিজ্যিক বিমান সমূহকে সমূদ্রের উপরে আকাশপথে প্রবেশের আগে আটলান্টিক সেন্টারের সাথে যোগাযোগ করতে হয় কারন পরবর্তী এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের হাতে সমর্পন করার পূর্ব পর্যন্ত বিমানটি নিয়ন্ত্রন করে আটলান্টিক সেন্টার। ক্যাপ্টেন মার্ক দ্যুবোয়া আটলান্টিক সেন্টারের সাথে যোগাযোগ করে তাঁর অবস্থান জানান। এই সময় তিনি ব্রাজিল আকাশ সীমার সর্বশেষ ওয়েপয়েন্ট ইন্টল অতিক্রম করছিলেন। আটলান্টিক সেন্টার বিমানের উর্ধসীমা ৩৫০০০ ফিট নির্ধারন করে তাঁকে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। ভোর ২:১০ মিনিটে ফ্লাইট ৪৪৭ মধ্য আটলান্টিকের কমিউনিকেশন ডেড জোনে প্রবেশ করলে  বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ সম্পূর্নরুপে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

বিশ্রাম শেষে ফার্ষ্ট অফিসার ডেভিট রবার্ট বা ডেভ রব্যা ককপিটে এলে ক্যাপ্টেন মার্ক দ্যুবোয়া বিশ্রামে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ক্যাপ্টেন দ্যুবোয়া খুবই ক্লান্ত ছিলেন কারন সন্ধ্যায় ফ্লাইট ৪৪৭ এ উঠার আগে তিনি মাত্র এক ঘন্টা ঘুমুতে পেরেছিলেন। ক্যাপ্টেন মার্ক দ্যুবোয়া বিশ্রামে যাওয়ার পর ক্যাপ্টেনের সীটে ডেভ রব্যা বসলেও বিমানের নিয়ন্ত্রন থাকে অটো পাইলটের হাতে এবং সার্বক্ষনিক মনিটরিং এবং তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষমতা থাকে ফার্ষ্ট অফিসার বুনাঁর হাতে। এ সময় বিমানটি মধ্য আটলান্টিক মহাসাগরের সবচাইতে ঝন্জাবহুল অন্চল অতিক্রম করছিল। এটি এমন একটি অন্চল যেখানে পৃথিবীর দু’প্রান্ত থেকে প্রবাহিত বাণিজ্য বায়ু মিলিত হয়ে সবচাইতে ভয়ংকর বৈদ্যুতিক ঝড়ের সৃষ্টি করে। এই ভয়ংকর এলাকার আকাশে ক্রমাগত মেঘ তৈরী হতে থাকে এবং ঘন্টায় তিন শ কিলোমিটারেরও অধিক বেগে ঘূর্ণীবায়ূ বয়ে যেতে থাকে। ঘন্টায় ৩১০ মাইল বেগে চলতে চলতে বিমানটি হঠাৎ করেই বরফ ক্রিষ্টাল বোঝাই মেঘের ভেতর প্রবেশ করলে কিছু বরফ গতিবেগ নির্ণয়কারী পিটোটিউবের ভেতর ঢুকে পরায় বাতাসের প্রবাহ বিঘ্নিত হয়ে গতিবেগ প্রদর্শনকারী মনিটর ত্রুটিপূর্ন রিডিং দিতে থাকে। বিমানের অটোপাইলট প্রকৃত গতিবেগ বুঝতে না পেরে একেবারে হঠাৎ করেই বিমানের নিয়ন্ত্রন ছেড়ে দেয়। এয়ারবাস কোম্পানী অনেক আগেই এ ৩৩০ এবং এ ৩৪০ বিমানের পিটোটিউব সমস্যার কথা বিমান সংস্থা সমূহকে জানিয়েছিল এবং পাইলটদের এ বিষয়ে করনীয় সম্পর্কে প্রশিক্ষনও প্রদান করা হয়েছিল। পিটোটিউবে বরফ জমে যে সমস্যা সৃষ্টি হয় তার মেয়াদ হচ্ছে ছাপ্পান্ন সেকেন্ড। এর মধ্যেই পিটোটিউব স্বয়ংক্রিয়ভাবে বরফ গলিয়ে কাজ শুরু করে এবংঅটোপাইলট পুনরায় নিজে থেকে নিয়ন্ত্রন গ্রহন করে। নিয়ম হচ্ছে এই ছাপ্পান্ন  সেকেন্ড যে কোন একজন পাইলট বিমানের নিয়ন্ত্রন গ্রহন করে অটোপাইলট পুনরায় নিয়ন্ত্রন গ্রহন করা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। এ সময় পাইলট বিমানের গতি কিংবা দিক ইত্যাদির কোন ধরনের পরিবর্তন করবে না। কিন্তু, ফ্লাইট ৪৪৭ এর অটোপাইলট নিয়ন্ত্রন ছেড়ে দেয়ার সাথে সাথে ফার্ষ্ট অফিসার বুনাঁ কোন অজানা কারনে  বিমানের নাক উপর দিকে তুলে দেয়। যেহেতু ৩৫ হাজার ফিট উপরে বাতাস অত্যন্ত পাতলা, নাক উপরের দিকে তুলে দেয়ায় বিমানের ডানার নীচ থেকে বাতাস সরে গেলে বিমানের গতিবেগ হ্রাস পায়। বিমানটির গতিবেগ ৩১০ নটিক্যাল মাইল থেকে কমে ২২০ এ চলে আসে ফলে একটি অ্যারোডাইনামিক ষ্টল অবস্থার সৃষ্টি হয় এবং বিমানটি  পরে যেতে থাকে। এ ধরনের অবস্থায় নিয়ম হচ্ছে বিমানের নাকটি নীচু করা যাতে ভেসে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় গতি অর্জন করা যায়। কিন্তু, যথেষ্ট প্রশিক্ষন ও অভিজ্ঞতা থাকা সত্বেও ফার্ষ্ট অফিসার বুনাঁ আরও বেশী করে বিমানটির নাক উপর তুলতে থাকেন ফলে বিমানটি খুব দ্রুত উচ্চতা হাড়ায়। এ পর্যায়ে বিমানটি প্রতি মিনিটে ১২০০০ ফিট উচ্চতা হাড়াতে থাকে। ফার্ষ্ট অফিসার রব্যা বিষয়টি লক্ষ্য করে বিমানের নিয়ন্ত্রন নিজের হাতে নিয়ে নাক নীচু করার চেষ্টা করতে থাকেন কিন্তু একই সাথে ফার্ষ্ট অফিসার বুনাঁ তাঁর ষ্টিয়ারিং ষ্টিকটি ব্যবহার করে বিমানের নাক উচু করার চেষ্টা করতে থাকেন। ফলে বিমান উচ্চতা হাড়িয়ে ২২০ মাইল গতিতে সমূদ্রের বুকে সরাসরি নেমে আসে এবং ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে ১২০০০-১৩০০০ ফিট পানির নীচে তলিয়ে যায়। একেবারে শেষ মুহুর্তে ক্যাপ্টেন দ্যুবোয়া ককপিটে এলেও তাঁর করার কিছু ছিল না। বিমান সমূদ্রে আছড়ে পরার সময় সব যাত্রী ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলেন ফলে তাদের অজান্তেই মৃত্যু এসেছে হঠাৎ করে।

২০১২ সনের ৫ই জুলাই ফ্রান্সের তদন্ত ও বিশ্লেষন ব্যুরো (বিইএ) এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইট ৪৪৭ দূর্ঘটনার বিষয়ে চুড়ান্ত রিপোর্ট প্রকাশ করে। এতে বিমান দুর্ঘটনা ও যাত্রী এবং ক্রুদের মৃত্যুর জন্য বিমানটির পাইলটদের অদক্ষতা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহনে অপারগতাকে দায়ী করা হয়।

 দূর্ঘটনার ঠিক পরপরেই এয়ার ফ্রান্স তার রিও ডি জেনিরো-প্যারিস ফ্লাইটের কোড এএফ ৪৪৭ থেকে এএফ ৪৪৫ এ পরিবর্তন করে।


মে ডে: পরবর্তী পর্ব- জার্মানীর আকাশে সংঘর্ষ: ঝরে পরলো ৪৮টি উদীয়মান উজ্জল নক্ষত্র