ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লী। ১২ই নভেম্বর ১৯৯৬ সন। প্রায় সন্ধ্যা। দিল্লীতে শীত প্রায় আসি আসি করছে। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমের দিনগুলো কেটে গিয়ে প্রকৃতিতে তাই এক স্বস্তিকর আনন্দের আমেজ। ইন্দিরা গান্ধি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। ভারতের প্রবেশ দ্বার। ১৯৯০ সনের পূর্ব পর্যন্ত এটি ছিল এয়ার ইন্ডিয়া এবং ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স, ভারত সরকার নিয়ন্ত্রিত এই দুটো বিমান সংস্থার জন্য নির্ধারিত ছোট একটি বিমান বন্দর। নব্বই সনের পর ভারত সরকার “ওপেন স্কাই” নীতি গ্রহণ করে বেশ কটি দেশের সাথে আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল চুক্তি স্বাক্ষর করলে বিমান বন্দরটি অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে উঠে। বিমান চলাচলের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায়, অনেকগুলো বিদেশী বিমান সংস্থা এই বিমান বন্দরটি ব্যবহার করা শুরু করে। এদের মধ্যে অন্যতম হল সাউদিয়া-সৌদি এরাবিয়ান এয়ারলাইন্স। ভারত থেকে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার যাত্রী মধ্যপ্রাচ্যে তাঁদের কর্মস্থলে যাতায়াত করে থাকেন। এই যাত্রীদের বড় একটি অংশ সাউদিয়ার বিমান পরিসেবা গ্রহণ করেন। তবে ইন্দিরা গান্ধি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে বিমান চলাচল অনেক বৃদ্ধি পেলেও এর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কোন পরিবর্তন হয় নি। এই ১৯৯৬ সনেও বিমান বন্দরটি নব্বই পূর্ববর্তী প্রযুক্তি ব্যবহার করেই বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছে। আধুনিক বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রনের ক্ষেত্রে সেকেন্ডারী সার্ভিল্যান্স রাডার একান্ত প্রয়োজনীয় একটি ব্যবস্থা। কিন্তু এই ১৯৯৬ সনেও ইন্দিরা গান্ধি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের এপ্রোচ কন্ট্রোলারদের নির্ভর করতে হয় প্রাচীন আমলের প্রাইমারী রাডারের উপর।
যে কোন আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের মতই বিমান চলাচলের জন্য দিল্লী বিমান বন্দরে
দু ধরনের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রয়েছে। মাটিতে থাকা অবস্থায় বিমানের নিয়ন্ত্রণ থাকে গ্রাউন্ড কন্ট্রোলের হাতে। বিমান রানওয়ে ত্যাগ করলে অথবা রানওয়েতে অবতরণের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত হয় এপ্রোচ কন্ট্রোলের মাধ্যমে।
সন্ধ্যে ৬.১৫ মিনিট। ইন্দিরা গান্ধি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের এপ্রোচ কন্ট্রোল। এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার বি কে দত্ত সবে মাত্র দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। এই মুহূর্তে এপ্রোচ কন্ট্রোলের প্রাইমারী রাডারের আওতায় মোট পাঁচটি ফ্লাইট রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি হল অগ্রাধীকারপ্রাপ্ত। টারমাকে দাড়িয়ে উড্ডয়ন অনুমতির জন্য অপেক্ষা করছে সাউদিয়া এয়ার লাইন্সের ফ্লাইট এসভিএ ৭৬৩। বিশাল দ্বিতল জাম্বোজেট বোয়িং ৭৪৭-১৬৮বি বিমানটিতে দিল্লী থেকে সৌদি আরবের দাহরান যাবেন মোট ২৮৯ জন যাত্রী। এদের বেশীর ভাগই অর্থাৎ ২১৫ জনই ভারতীয়। ৪০ জন নেপালি এবং অন্যদের মধ্যে একজন বাংলাদেশী সহ পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের নাগরিকবৃন্দ রয়েছেন। বিমানটি পরিচালনা করবে ২৩ সদস্যের ক্রুদের একটি চৌকস দল। অপর ফ্লাইট দুটো এই মুহূর্তে আকাশে রয়েছে। কাজাখস্থান এয়ার লাইন্সের ফ্লাইট কেজেডএ ১৯০৭ একটি চার্টার্ড বিমান। কিরঘিজস্তানের একটি কোম্পানি এই বিমানটি ভাড়া করেছে। রাশিয়ায় নির্মিত ইলিউশিন টু ৭৬ টিডি বিমানটিতে রয়েছে ৩৭জন যাত্রী এবং ক্রু। আকাশে উড়ন্ত অগ্রাধীকারপ্রাপ্ত অপর বিমানটি যুক্তরাষ্ট্র বিমান বাহিনীর একটি পরিবহন বিমান। লকহীড সি-১৪১বি ষ্টারলিফ্টার বিমানটি চালাচ্ছেন ক্যাপ্টেন টিমোথী জে প্লেস। এটি রয়েছে ২০ হাজার ফিট উপরে।
সন্ধ্যে ৬:৩২ মিনিট। সাউদিয়া ফ্লাইট এসভিএ ৭৬৩ এপ্রোচ কন্ট্রোলের অনুমতি পেয়ে রানওয়ে ত্যাগ করে নয়াদিল্লীর মেঘলা আকাশের দিকে উড়ে গেল। ঠিক একই সময়ে দিল্লী থেকে ১১৯ কিলোমিটার দূরে আকাশের ২০ হাজার ফিট উপর থেকে কাজাখ ফ্লাইট ১৯০৭ এপ্রোচ কন্ট্রোলার বি কে দত্তের কাছে ফ্লাইট লেভেল পরিবর্তনের অনুমতি চাইলে দত্ত কাজাখ ফ্লাইটিকে ১৫ হাজার ফিটে নেমে এসে স্থির হওয়ার জন্য অনুমতি দিল। একই এয়ার করিডোরে উড়ন্ত সাউদিয়া ফ্লাইট ৭৬৩ এর জন্য নির্ধারিত ফ্লাইট লেভেল হচ্ছে ১৪ হাজার ফিট। সুতরাং ধারনা করা যায় কাজাখ ফ্লাইট ও সাউদিয়া পরস্পরকে অতিক্রম কালে দুটি বিমানের মধ্যে প্রায় ১ হাজার ফিট দূরত্ব থাকবে। সাউদিয়ার বোয়িং ৭৪৭-১৬৮বি পরিচালনা করছেন ক্যাপ্টেন খালিদ আল সুবাইলী, কো-পাইলট হচ্ছেন ফার্ষ্ট অফিসার নজর খান এবং ফ্লাইট ইন্জিনিয়ারের দায়িত্ব পালন করছেন এদ্রীস আরাবীয়া। কাজাখ ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন হলেন গেন্নাদী চেরেপেনভ এবং রেডিও অপারেটর হলেন আইগর রেপ। করিডোরে ২০ হাজার ফিট উপরে রয়েছেন ক্যাপ্টেন টিমোথী জে প্লেস। লকহীড সি-১৪১বি ষ্টারলিফ্টার বিমানটি একটি মিলিটারি বিমান হলেও আজ এর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে ইন্দিরা গান্ধি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের এপ্রোচ কন্ট্রোলার বি কে দত্তের হাতে।
সন্ধ্যে ৬:৩৯ মিনিট। সাউদিয়া ৭৬৩ এর কমান্ডার ক্যাপ্টেন খালিদ এপ্রোচ কন্ট্রোলকে জানালেন যে তিনি প্রত্যাশিত ১৪ হাজার ফিটে পৌঁছে গেছেন এবং আরও উপরে উঠার অনুমতি চাইছেন। বি কে দত্ত ক্যাপ্টেন খালিদকে ১৪ হাজার ফিট উচ্চতা বজায় রাখার নির্দেশ দিল।
সন্ধ্যে ৬:৪০ মিনিট। কাজাখ ফ্লাইট ১৯০৭ থেকে ক্যাপ্টেন গেন্নাদী এপ্রোচ কন্ট্রোলকে জানালেন যে তিনি তাঁর জন্য নির্ধারিত ১৫ হাজার ফিট উচ্চতায় নেমে এসেছেন। বি কে দত্ত গেন্নাদীর উদ্দেশ্যে বলল;
- কাজাখ ফ্লাইট ১৯০৭। ১৫ হাজার ফিটে বিমান স্থীর রাখ। তোমার বিপরীত দিক থেকে সাউদিয়ার বিমান আসছে। বিমানটি একটি বোয়িং ৭৪৭ এবং তোমার ১০ মাইলের মধ্যে রয়েছে। সম্মুখ দিকে লক্ষ্য রাখ এবং বিমানটি দেখা মাত্র আমাকে জানাও।
কাজাখ ফ্লাইট থেকে কোন প্রত্যুত্তর না পেয়ে দত্ত আবার বলর;
- কাজাখ ফ্লাইট ১৯০৭। জবাব দাও। আমার কথা কি শুনতে পারছ?
- কাজাখ ফ্লাইট ১৯০৭। আমার কথা কি শুনতে পারছ?
কাজাখ ফ্লাইটের সাথে যোগাযোগের জন্য বি কে দত্ত বারবার চেষ্টা করা সত্বেও কোন ধরনের জবাব পাচ্ছিল না। ওদিকে প্রায় ২০ হাজার ফিট উপর দিয়ে লকহীড সি-১৪১বি ষ্টারলিফ্টার বিমানটি উড়ে আসছিল। ক্যাপ্টেন টিমোথী তাঁর বিমানের নীচে ডান দিকে ভাসমান মেঘের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। হঠাৎ তাঁর চোখের সম্মুখে কালো মেঘ কমলা রঙে আলোকিত হয়ে উঠে। ক্যাপ্টেন টিমোথী প্রথমে ভাবলেন তাঁর বিমান লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই রংটি মিলিয়ে যেতেই বুঝতে পারলেন যে মেঘের ঠিক নীচেই একটি বিস্ফোরণ ঘটেছে এবং এপ্রোচ কন্ট্রোলের সাথে যোগাযোগ করে তিনি বিস্ফোরণের কথাটি জানালেন। এর মধ্যে বি কে দত্ত উভয় ফ্লাইটের সাথে যোগাযোগের একাধিক চেষ্টা করেও কোন জবাব পায় নি। ক্যাপ্টেন টিমোথী যখন মেঘের নীচে বিস্ফোরণের কথা বলছিলেন তখনও প্রাইমারী রাডারে উভয় বিমানটিকে দেখা যাচ্ছিল। হঠাৎ করেই রাডার থেকে বিমান দুটি অদৃশ্য হয়ে গেলে বিমান দুর্ঘটনার ভয়ংকর সম্ভাবনার কথাটি বি কে দত্তের মনে আঘাত হানলো। পরক্ষনেই ক্যাপ্টেন টিমোথী জানালেন যে তিনি নীচের মাটিতে দুটি প্রজ্বলিত ধংসস্তুপ দেখতে পাচ্ছেন। ইতোমধ্যে এপ্রোচ কন্ট্রোলের অন্যান্য অপারেটররা দুর্ঘটনার বিষয়টি বুঝতে পেরে বি কে দত্তকে কক্ষের বাইরে নিয়ে গেল।
মুহূর্তের মধ্যে বিমান দুর্ঘটনার কথাটি চারিদিকে ছড়িয়ে পরে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানালেন দিল্লীর প্রায় ৬৫ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত চরখি দাদ্রি গ্রামের সরিষা ক্ষেতে দুটি বিমান ভেঙ্গে পরেছে এবং সেখানে এই মুহূর্তে আগুন জ্বলছে। বিমান দুটিতে মোট ৩৪৯ জন যাত্রী ছিল। দুটি বিমানের মধ্যে ১ হাজার ফিট দূরত্ব থাকা সত্বেও কি ভাবে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এ নিয়ে ব্যাপক প্রশ্নের জন্ম হলেও দুর্ঘটনা পরবর্তী সময়ে প্রধান যে বিষয়টি গুরুত্ব পায় তা হল উদ্ধার কাজ। দুর্ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই উদ্ধার কর্মী এবং অগ্নি নির্বাপণ দল চরখি দাদ্রি গ্রামে উপস্থিত হলেন। কিন্তু প্রজ্বলিত বিমান দুইটির আশে পাশে প্রচণ্ড তাপমাত্রার কারণে তাৎক্ষনিক ভাবে উদ্ধার কর্ম পরিচালনা সম্ভবপর না হওয়ায় অগ্নি নির্বাপণ দল আগুন নেভানোর কাজে তৎপর হলেন। কয়েক ঘণ্টা পর আগুনের তীব্রতা কমে এলে উদ্ধার কর্মীরা জীবিত এবং আহত যাত্রীদের খোঁজে তৎপর হলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠলো যে সাউদিয়া ফ্লাইট ৭৬৩ এবং কাজাখ ফ্লাইট ১৯০৭ এর যাত্রী এবং ক্রুদের মধ্যে বেশীরভাগই বিমান দ্বয় মাটিতে আছড়ে পরার সাথে সাথে নিহত হয়েছেন। শুধু কাজাখ ফ্লাইটের চারজন যাত্রীকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা গেলেও হাসপাতালে নেয়ার আগেই তাঁরা মৃত্যু বরন করেন।
বিমান দুর্ঘটনার পরপরেই এটি একটি আন্তর্জাতিক হেড লাইন নিউজে পরিণত হয়। সমগ্র বিশ্বের টিভি চ্যানেলগুলো এই দুর্ঘটনার সংবাদ বার বার প্রচার করতে থাকে। সমগ্র বিশ্ব জুড়ে একটি প্রশ্ন উচ্চারিত হতে থাকে; বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তির যুগে দু দুটি আধুনিক বিমান কি ভাবে পরস্পরকে মুখোমুখি ধাক্কা দিয়ে ধংস হয়ে যেতে পারে? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে ভারত সরকার ব্যাপক তদন্ত শুরু করে এবং এই তদন্তের দায়িত্ব প্রদান করা হয় এয়ার এক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্রাঞ্চ নামক সংস্থাটিকে।
তদন্তকারীদের কারণ খুঁজে করতে হবে যে এপ্রোচ কন্ট্রোল কর্তৃক প্রতিটি বিমানের জন্য সুনির্দিষ্ট এবং ভিন্ন উচ্চতা নির্ধারণ করে দেয়া সত্বেও কি ভাবে দুটি বিমান একই উচ্চতায় এসে পরস্পরকে আঘাত করে ধংস হয়ে যায়।
দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্য
No comments:
Post a Comment