Tuesday, June 25, 2013

জার্মানীর আকাশে মধ্যরাতে সংঘর্ষ- ঝরে গেল ৪৮টি উদীয়মান নক্ষত্র- শেষ পর্ব

 






















জার্মানির আকাশে ৩৬০০০ ফিট উপর দিয়ে উড়ছে বাস্কারিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট বিটিসি ২৯৩৭ আর ইতালি থেকে সুইজারল্যান্ডের আকাশে একই উচ্চতায় উড়ে চলেছে আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সংস্থা ডিএইচএল এর ফ্লাইট ডিএইচএক্স ৬১১ঘণ্টায় গড়ে ৯০০ কিলোমিটার বেগে উড়ন্ত এই বিমান দুটি দক্ষিণ জার্মানি ও উত্তর সুইজারল্যান্ড সীমান্তের আকাশে পরস্পরকে অতিক্রম করবে  বাস্কারিয়ান এয়ারলাইন্স বহন করছে মোট ৬৯ জন যাত্রী যাদের মধ্যে ৪৮ জন শিশু কিশোরএরা বাস্কারিয়ান প্রজাতন্ত্র নামক দেশটির অত্যন্ত মেধাবী নবীন নাগরিকডিএইচএল এর বিমানটি বহন করছিল মধ্যপ্রাচ্য এবং ইটালি থেকে সংগ্রহীত কুরিয়ার সামগ্রী এবং দুজন পাইলটএই বিমানটি বাহরাইন থেকে রওয়ানা হয়ে প্রথমে ইটালির বার্গেমো এসে সবশেষে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস এ অবতরণ করবে

রাত ১১:৩৪ মিনিটসুইস বেসরকারি এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল স্কাইগাইডের জুরিখস্থ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রএয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার পিটার নেলসন একাই দুটি মনিটরে প্রদর্শিত বিমানগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেএই মুহূর্তে পিটারের সম্পূর্ণ মনোযোগ এরোলয়েডে এয়ারওয়েজ ফ্লাইট ১১৩৫ এর উপরযাত্রীবাহী এই এয়ারবাসটি নিকটবর্তী  ফ্রিডরিকসহাফেন বিমান বন্দরে অবতরণের জন্য পিটারের সহযোগিতা চাচ্ছেপিটারের সমস্যা হলো, বাস্কারিয়ান এবং ডিএইচএল এর বিমান দুটি প্রদর্শিত হচ্ছে ১ নং মনিটরে এবং এরোলয়েড ফ্লাইটটি দেখা যাচ্ছে ২ নং মনিটরেদুটি মনিটরের মধ্যে প্রায় এক গজের দূরত্বফলে পিটার যখন ১নং মনিটরে মনোযোগ দিচ্ছিল তখন ২নং মনিটরটি অনিয়ন্ত্রিত থাকছিল১নং মনিটর পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে পিটার বুঝতে পারল যে বাস্কারিয়ান ফ্লাইট ২৯৩৭ এবং ডিএইচএল ফ্লাইট ৬১১ একই উচ্চতায় পরস্পরকে লক্ষ্য করে এগিয়ে আসছেএটি একটি কলিশন কোর্স অর্থাৎ বিমান দুটি একই উচ্চতায় থেকে পরস্পরের বিপরীত দিক থেকে এগিয়ে আসতে থাকলে মুখোমুখি সংঘর্ষ হতে পারেপিটার বিষয়টি বুঝতে পেরে সাথে সাথে বাস্কারিয়ান ফ্লাইট ২৯৩৭কে এক হাজার ফুট নীচে অর্থাৎ ৩৫০০০ ফিটে নেমে আসার নির্দেশ দিলএকই সময় এরোলয়েড ফ্লাইট ১১৩৫ এর পাইলট পিটারের কাছে অবতরণ নির্দেশিকা চাইলে পিটার এই ফ্লাইটটিকে সরাসরি ফ্রিডরিকসহাফেন বিমান বন্দরের কন্ট্রোলের কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফোন করতে গিয়ে বুঝতে পারল যে বহির্মুখী ফোন লাইনটি কাজ করছে নাব্যাকআপ ফোনটির সাহায্য নিতে গিয়েও দেখা গেল সেটিও নষ্টবাধ্য হয়েই পিটার এরোলয়েড ফ্লাইটের ক্যাপ্টেনকে সরাসরি ফ্রিডরিকসহাফেন বিমান বন্দরের কন্ট্রোলের সাথে যোগাযোগ করে অবতরণ সহায়তা চাওয়ার পরামর্শ দিলএরই মধ্যে বাস্কারিয়ান ফ্লাইটের টি-ক্যাস যন্ত্রটি ডিএইচএল ফ্লাইটটির উপস্থিতি বুঝতে পেরে কলিশন এলার্ট প্রদান শুরু করেছেবাস্কারিয়ানের পাইলটরা বুঝতে পারছে যে বড় একটি বিমান একই উচ্চতায় থেকে তাদের দিকে এগিয়ে আসছেটি-ক্যাস বলছে ক্লাইম্ব অর্থাৎ মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য উপরে উঠোকয়েক সেকেন্ড পরে ডিএইচএল ফ্লাইটের টি-ক্যাস কলিশন এলার্ট দিয়ে পাইলটকে ডিসেন্ট অর্থাৎ নীচে নামার নির্দেশ দিলএ সময় পিটার এরোলয়েড ফ্লাইটের সাথে কথা বলতে থাকায় ডিএইচএল এর টি-ক্যাস এলার্টটি তার কানে যায় নিডিএইচএল ফ্লাইটটির ক্যাপ্টেন পল ফিলিপ্স টি-ক্যাস এলার্ট শুনে নিয়ম অনুযায়ী এক হাজার ফিট নীচে নামার জন্য বিমানের নাক নিচু করলেনকিন্তু বাস্কারিয়ান ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন অ্যালেক্সান্ডার গ্রস তাঁর বিমানের টি-ক্যাস যন্ত্রটির উপরে উঠার নির্দেশ অগ্রাহ্য করে স্কাইগাইডের কন্ট্রোলার পিটার নেলসনের সহায়তা চাইলেনএরোলয়েড ফ্লাইটটিকে ফ্রিডরিকসহাফেন বিমান বন্দরের কন্ট্রোলের সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়ে পিটার এক নং মনিটরে এসে লক্ষ্য করলো বাস্কারিয়ান ও ডিএইচএল ফ্লাইট দুটি এখনও একই উচ্চতায় রয়েছে, তাই সে বাস্কারিয়ান ফ্লাইটের ক্যাপ্টেনকে অতি দ্রুত নীচে নামার নির্দেশ দিলবাস্কারিয়ান ফ্লাইটের ককপিটে এই মুহূর্তে একটি জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছেটি-ক্যাস বলছে অতি দ্রুত উপরে উঠতে আর স্কাইগাইড থেকে নীচে নামার নির্দেশ দেয়া হয়েছেএকদম শেষ মুহূর্তে পাইলটরা স্কাইগাইডের নির্দেশ মান্য করার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিমানের নাক নিচু করলো ফলে উভয় বিমান আরও দ্রুত পরস্পরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেএরোলয়েড ফ্লাইটটি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার পিটার নেলসন জানতেই পারে নি যে টি-ক্যাসের নির্দেশে ডিএইচএল ফ্লাইটটি ইতোমধ্যেই নীচের দিকে নামা শুরু করেছে। এ ধরনের একটি জটিল মুহুর্তে স্কাইগাইডের আকাশ পথে চলাচলকারী বিমানের উপর লক্ষ্য রাখার মূল রাডারটি বন্ধ থাকায় বিমান দুটোর প্রকৃত উচ্চতা বোঝাও পিটারের পক্ষ্যে সম্ভব ছিল না। এর মধ্যে আরেকটি দূর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটছিল, বিমান বন্দরের আর্লি ওয়ার্নিং সিষ্টেমের দায়ীত্বে থাকা অপারেটর তখন চা পান করার জন্য ক্যাফেটেরিয়াতে গিয়েছিল। ফলে বিমান দুটি সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার দুই মিনিট আগেই আর্লি ওয়ার্নিং সিষ্টেম কলিশন সংকেত প্রদান করলেও তা শোনার জন্য কেউই ছিল না।   

ঠিক রাত ১১:৩৫:৫২ সেকেন্ডে বাস্কারিয়ান ফ্লাইট ২৯৩৭ এবং ডিএইচএল ফ্লাইট ৬১১ আকাশের ৩৪৮৯০ ফিট উচ্চতায় পরস্পরকে ধাক্কা মারলসংঘর্ষের প্রচণ্ডতায় বোয়িং ৭৫৭ বিমানটির টেইল সেকশন এর ভার্টিক্যাল ষ্ট্যাবিলাইজার ছুড়ি দিয়ে যে ভাবে কেক কাটে, সেভাবেই টুপোলভ টিইউ ১৫৪ বিমানটিকে কেটে দুটুকরো করে ফেলেবিমানের ককপিট সহ নোজ সেকশনটি খুব দ্রুত নীচের দিকে পরে যেতে থাকে আর ইন্জিন সহ টেল সেকশন আরও কয়েক সেকেন্ড উড়ন্ত থেকে তারপর ধীরে ধীরে নীচের দিকে নেমে আসেডিএইচএলের বোয়িং ৭৫৭ এর টেল সেকশনের ভার্টিক্যাল ষ্ট্যাবিলাইজারটির প্রায় ৮০% ধংস হয়ে গেলেও বিমানটি আরও ২মিনিট আকাশে ভেসে থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার উড়ে গিয়ে টেইসার্সড্রফ নামের একটি গ্রামের জঙ্গলের উপরে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পরেবাস্কারিয়ান ফ্লাইটের ৬৯ জন এবং ডিএইচএলের ২ পাইলট সহ সবাই তাৎক্ষনিক ভাবে প্রাণ হারালেন

বিমান দুটি সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই পিটার নেলসন বিষয়টি বুঝতে পারেকিন্তু তখন তার কিছুই করার ছিল নাএটি একটি সত্যিকারের দুর্ভাগ্যজনক বিমান দুর্ঘটনা এবং অনেকগুলো অস্বাভাবিক ঘটনা অনাকাংখিতভাবে এক সাথে ঘটার কারনেই বিমান দুটির ভাগ্য বিপর্যয় ঘটেছিল

দুর্ঘটনা পর পরই বাহরাইন, রাশিয়া এবং জার্মানির বিমান দুর্ঘটনা তদন্ত সংস্থাগুলো বিভিন্নভাবে তদন্ত করে দুর্ঘটনার কারনগুলো খুঁজে বেড় করেএতে সবাই একমত হয় যে সুইজারল্যান্ডের বেসরকারি এয়ার ট্রাফিক সংস্থা স্কাইগাইডের দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও লোক স্বল্পতাই দুর্ঘটনাটির প্রধান কারনএ ছাড়া বাস্কারিয়ান ফ্লাইটটির পাইলটদের টি-ক্যাস যন্ত্রের নির্দেশ অমান্য করে নীচের দিকে নামাটিও আরেকটি প্রধান কারন

দুর্ঘটনার পরে পিটার নেলসন চাকুরী ছেড়ে দিয়ে অজ্ঞাতবাসে চলে যায় তবে ২০০৪ সনের ২৪ ফেব্রুয়ারি জুরিখের নিকটবর্তী ক্লোটেন নামক স্থানে রাশিয়ান স্থপতি ভিটালী কলোয়েভ এর ছুরিকাঘাতে নিহত হয়বিমান দুর্ঘটনা তাঁর পরিবারের সকল সদস্যের মৃত্যুর জন্য ভিটালী পিটারকে দায়ী মনে করতেনএই হত্যাকাণ্ডের জন্য ভিটালীকে কারাদণ্ড দেয়া হলেও তাঁর মানসিক অবস্থার কথা বিবেচনায় এনে ২০০৭ সনে তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়

বাস্কারিয়ান ফ্লাইট ২৯৩৭ এবং ডিএইচএল ফ্লাইট ৬১১ এর মুখোমুখি সংঘর্ষের ফলে নিহতদের স্মরণে জার্মান সরকার ইউবারলিনজেন গ্রামে একটি স্মৃতিসৌধ তৈরি করেছেদুর্ঘটনায় নিহত ৭১ জন অকাল প্রয়াত মানুষের নিকট আত্মীয়রা ছিন্ন হওয়া মুক্তার মালার আকৃতির এই স্মৃতি সৌধটিতে প্রতি বছর ১লা জুলাই তারিখে শোকতপ্ত মনে আসেন দুর্ভাগা মানুষগুলোর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেআর নিহত ৪৮ জন মেধাবী শিশু কিশোরদের মাতৃভূমি বাস্কারিস্থানের মানুষরা প্রতি বছর এই দিনে অনেক শ্নেহ আর ভালবাসার সাথে স্মরণ করেন তাঁদের অকালে হাড়িয়ে যাওয়া সন্তানদের

No comments:

Post a Comment