Saturday, June 8, 2013

আটলান্টিকে হাড়িয়ে গেল এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইট এএফ ৪৪৭- শেষ পর্ব

 

১লা  জুন ২০০৯। মধ্য আটলান্টিকের ঝন্জা বিক্ষুদ্ধ আকাশ পথে উড্ডয়নরত অবস্থায় হাড়িয়ে গেছে বিশ্বের বৃহৎ বিমান পরিবহন সংস্থা এয়ার ফ্রান্সের ফ্লাইট এএফ ৪৪৭। অত্যাধুনিক সুপরিসর এয়ারবাস এ ৩৩০-২০০ বিমান যোগে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো থেকে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস যাচ্ছিলেন ২১৬ জন যাত্রী এবং ১২ জন ক্রু। ব্রাজিল সময় ৩১শে মে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় বিমানটি প্যারিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। কোঅর্ডিনেটেড ইউনিভার্সাল টাইম ১লা জুন ভোর ১:৪৮ মিনিটে বিমানটি মধ্য আটলান্টিকের কমিউনিকেশন ডেড জোনে প্রবেশ করে। দু ঘন্টা পর সেনেগালের ডাকার এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের একজন অপারেটর ফ্লাইট এএফ ৪৪৭ এর সাথে রেডিও যোগাযোগের চেষ্টা করলে জানা যায় যে বিমানটি নিখোঁজ হয়েছে। ফ্লাইট ৪৪৭ এর নিখোঁজ হওয়ার সংবাদে সমগ্র বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং ব্রাজিল, ফ্রান্স, স্পেন ও যুক্তরাষ্ট্র একসাথে অনুসন্ধান অভিযান শুরু করে। ২রা জুন ২০০৯ অপরান্হে, ব্রাজিলিয় বিমান বাহিনীর একটি এমব্রায়ার বিমান  ফ্লাইট ৪৪৭ এর সর্বশেষ অবস্থানের উপর অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে একটি বিমানের কিছু ধংসাবশেষ খুঁজে পায়। ২রা জুন বিকেলে ব্রাজিল সরকার ফ্লাইট এএফ ৪৪৭ এর দুর্ঘটনার সংবাদটি প্রকাশ করে।

ফ্লাইট ৪৪৭ নিখোঁজ হওয়ার পর ১লা জুন সকালে ব্রাজিলিয় বিমান বাহিনীর বেশ ক’টি বিমান অনুসন্ধানে যোগ দেয়। এরই একটি এমব্রায়ার আর ৯৯- এ বিমান ফারনান্দো ডি নরনহো দ্বীপান্চলের প্রায় ৬৫০ কিলোমিটার উত্তর পূর্ব এলাকায় সমূদ্রে ভাসমাণ অবস্থায় একটি বিমানের সামান্য কিছু ধংসাবশেষ খুঁজে পায়। এর মধ্যে ছিল একটি সীট, প্যাকেটকৃত অবস্থায় কয়েকটি লাইফ জ্যাকেট, একটি বয়া ইত্যাদি। ধংসাবশেষ পরীক্ষা করে জানা যায় এগুলো ফ্লাইট ৪৪৭ এরই অংশ।

ফ্লাইট ৪৪৭ নিখোঁজ হওয়ার পর ফ্রান্স সরকার এর রহস্য অনুসন্ধানের দায়ীত্ব দেয় ফ্রান্সের তদন্ত ও বিশ্লেষন ব্যুরো (বিইএ) উপর।  বিইএ’র প্রধান পল লুই আরসলানিয়নের নের্তৃত্বে বিইএ অনতিবিলম্বে তদন্ত শুরু করে।

২রা জুন দুপুরে ফরাসী নৌ বাহিনীর ফ্রীগেট ভেনটোস এবং হেলিকপ্টার বাহী জাহাজ মিষ্ট্রেল আটলান্টিকের সম্ভাব্য দুর্ঘটনাস্থলে ব্যপক তল্লাশী চালানোর জন্য রওয়ানা দেয়। ফরাসী সামুদ্রিক গবেষণা জাহাজ পরকুই পাসও এই অনুসন্ধানে অংশগ্রহন করে। এই জাহাজে সমুদ্রের তলায় অনুসন্ধান উপযোগী দুইটি মিনি সাবমেরিন ছিল। ধারনা করা হচ্ছিল দুর্ঘটনাস্থলে আটলান্টিকের গভিীরতা প্রায় ১৬০০০ ফিট এর মত হবে।

৩রা জুন ব্রাজিলিয় নৌ বাহিনীর পাঁচটি জাহাজ ফ্লাইট ৪৪৭ এর খোঁজে দুর্ঘটনাস্থলে পৌছে। ব্রাজিলিয়ান নৌ বাহিনী ও বিমান বাহিনীর যৌথ অনুসন্ধানের মাধ্যমে  ৬ই জুন  ফ্লাইট ৪৪৭ এর কজন যাত্রীর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এ সময় দুর্ঘটনা কবলিত বিমানের যাত্রীদের ভাসমান মৃতদেহের পাশ থেকে  ল্যাপটপ সহ একটি ব্যাকপ্যাক, একটি ব্রীফ কেস ইত্যাদি উদ্ধার করা হয়।

৭ই জুন অনুসন্ধানকারীরা ধংসপ্রাপ্ত বিমানের ভার্টিক্যাল ষ্ট্যাবিলাইজারটি উদ্ধার করেন। এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ন উদ্ধার কারন ভার্টিক্যাল ষ্ট্যাবিলাইজার পরীক্ষা করে বিমান দূর্ঘটনা বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা কিছুটা ধারনা করতে পারবেন। ১৭ই জুনের মধ্যে ব্রাজিলিয় এবং ফরাসী উদ্ধারকর্মীরা ৫০টি মৃতদেহ এবং ভেঙ্গে পরা বিমানের ৪০০টি ক্ষুদ্র অংশ উদ্ধার করেন। এ সময় বিমানের ক্যাপ্টেন মার্ক দ্যুবোয়া’র মৃতদেহ উদ্ধার করে ব্রাজিলিয় নৌ বাহিনী। ২৫শে জুন ব্রাজিল, ফ্রান্স, স্পেন ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ উদ্যোগে  সুমদ্রের উপর অংশে পরিচালিত উদ্ধার অভিযানের সমাপ্তি ঘোষনা করা হয়। কিন্তু হাড়িয়ে যাওয়া বিমানের ধংসাবশেষের খোঁজে সমদ্রের নীচে উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রাখা হয়। এ সময় বিমানের দুইটি ব্ল্যাক বক্স; ফ্লাইট ড্যাটা রেকর্ডার বা এফডিআর এবং ককপিট ভয়েস রেকর্ডার বা সিভিআর উদ্ধারের উপর সবচাইতে বেশী গুরুত্ব প্রদান করা হয়। এই গুরুত্বপূর্ন উদ্ধার কাজ পরিচালনার জন্য ফরাসী নৌ বাহিনী একটি পারমানবিক সাবমেরিন দুর্ঘটনাস্থলে প্রেরন করে।

এফডিআর এবং সিভিআর যে কোন যাত্রীবাহী বিমানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন দুইটি যন্ত্রাংশ। এফডিআর বা ফ্লাইট ড্যাটা রেকর্ডার বিমান চলাচল সংক্রান্ত সবধরনের তথ্য সংরক্ষন করে আর ককপিট ভয়েস রেকর্ডার বা সিভিআর বিমানের ককপিটের সমস্ত কথোপকথন যেমন ককপিটে অবস্থিত ক্রুদের মধ্যে কথাবার্তা অথবা ককপিট ক্রুদের সাথে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের কথোপকথন ইত্যাদি রেকর্ড করে রাখে। সাধারনত শেষ দুই ঘন্টার কথোপকথনের রেকর্ড থাকে সিভিআরএ। একটি বিমান দুর্ঘটনায় পরলে তদন্তকারীরা এফডিআর ও সিভিআর এর তথ্য সমূহ বিশ্লেষন করে দূর্ঘটনার কারন জানার চেষ্টা করেন। এফডিআর ও সিভিআরকে ব্ল্যাক বক্স বলা হলেও এগুলো উজ্জল কমলা রংএর হয় এবং পানি ও আগুন প্রতিরোধক কেসিংএর ভেতরে থাকে বিধায় দুর্ঘটনার সময় আগুন অথবা পানিতে এগুলো নষ্ট হয় না। এ ছাড়া, ব্ল্যাক বক্সে ইলেকট্রিক সিগন্যাল প্রদানকারী বিকন বসানো থাকে। এই বিকন দূর্ঘটনার পরবর্তী ৩০ দিন সিগন্যাল পাঠায় যাতে উদ্ধার কর্মীরা বিকন অনুসরন করে ব্ল্যাক বক্স দুটোকে খুঁজে পেতে পারে।এমনকি সমুদ্রের ৩ মাইল নীচ থেকে প্রেরিত  বিকন সিগনাল গ্রহন করে ব্ল্যাক বক্সের অবস্থান সনাক্ত করা সম্ভব। কিন্তু ব্ল্যাক বক্স উদ্ধারে ফরাসী এবং ব্রাজিলিয়ান নৌবাহিনীর সব ধরনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এফডিআর এবং সিভিআর উদ্ধার না হওয়ায় ফ্লাইট ৪৪৭ এর দূর্ঘটনার রহস্যটি অমিমাংসিত রয়ে যায়। তবে জুলাই মাসে ফরাসী অনুসন্ধান দল সমূদ্রের অনেক নীচ থেকে অত্যন্ত দূর্বল একটি বিকন সংকেত পেয়েছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে তা অস্বীকার করা হয়।

ইতোমধ্যে ফ্রান্সের তদন্ত ও বিশ্লেষন ব্যুরো (বিইএ) উদ্ধারকৃত বিমানের অংশ পরীক্ষা করে একটি বিষ্ময়কর তথ্য উদ্ঘাটন করে। বিশ্লেষকরা বিমানের কয়েকটি অংশ পরীক্ষা করে জানতে পারেন যে  আকাশ থেকে পতনের সময়  বিমানটি প্রচন্ড বেগে সমূদ্রে নেমে আসে। সাধারনত, যে কোন বিমান দূর্ঘটনার ক্ষেত্রে বিমানটি নোজ ডাইভ দিয়ে মাটিতে বা পানিতে নেমে আসে অর্থাৎ বিমান আকাশ থেকে খাড়াভাবে পরে যায়। কিন্তু ফ্লাইট ৪৪৭ এর ক্ষেত্রে এমনটি হয় নি। বিশ্লেষকরা দেখেন যে বিমানটি একই সাথে প্রচন্ড বেগে সামনের দিকে এগিয়েছে এবং খুব দ্রুত উচ্চতা হাড়িয়ে সমূদ্রে পরে গেছে।  এটি সত্যিই একটি অস্বাভাবিক দূর্ঘটনা। বিইএ’র অনুসন্ধানী দল বিমানটি থেকে প্রেরিত ২৪টি অ্যাকারস বার্তা পরীক্ষা করে জানতে পারে যে সর্বশেষ বার্তায় বিমানের পিটো টিউব এ ত্রুটি বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ দুর্ঘটনার সময় বিমানের একাধিক পিটোটিউব কাজ করছিল না। পিটো টিউব হচ্ছে বিমানের সম্মুখভাগে অবস্থিত ছিদ্রযুক্ত টিউব আকৃতির যন্ত্র। বিমান চলার সময় ছিদ্র দিয়ে বাতাস প্রবেশ করে গতি নির্দেশক কাটাটিকে ঘুড়িয়ে বিমানের গতিবেগ প্রকাশ করে। পিটো টিউব কাজ না করলে হয়তো বিমানের গতি জানা যাবে না কিন্তু এই ধরনের সমস্যায় দুর্ঘটনা ঘটার কোন সম্ভাবনাই নেই। বিশ্লেষকরা আরও জানতে পারে যে এক পর্যায়ে বিমানের অটো পাইলট বন্ধ হয়ে যায় এবং পাইলটরা বিমানের নিয়ন্ত্রন গ্রহন করেন। প্রাপ্ত তথ্যগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন হলেও এ থেকে দুর্ঘটনা সম্বন্ধে কোন চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব ছিল না।

১লা জুন ২০০৯ দুর্ঘটনা ঘটার পর থেকে মার্চ ২০১১ পর্যন্ত  ফ্রান্স, ব্রাজিল এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উদ্যেগে অসংখ্য অনুসন্ধান অভিযান পরিচালিত হয় ফ্লাইট ৪৪৭ এর ধংসাবশেষের খোঁজে এবং সবগুলোই ব্যার্থ হয়। এ সময় আটলান্টিক মহাসাগরের নীচে প্রায় ২২০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় অনুসন্ধান চালানো হয়। এই ব্যর্থতার কারনে ফ্রান্স সরকার অনুসন্ধান বন্ধ করে দিতে চাইলেও নিহত যাত্রী ও ক্রুদের আত্নীয় স্বজনের চাপে সরকার ২০১১ এর মার্চ মাসে বেসরকারী সামুদ্রিক উদ্ধার প্রতিষ্ঠান উডস ওসেনোগ্রাফিক ইনষ্টিটিউশনের সহায়তা গ্রহন করে এবং চতুর্থ পর্বের অনুসন্ধান অভিযান শুরু হয়। এপ্রিলের প্রথম থেকে এই ইনষ্টিটিউশন অত্যাধুনিক অটোনোমাস আন্ডারওয়াটার ভেহিক্যালের সহায়তায় সমুদ্রের নীচে ব্যপক অনুসন্ধান চালায় এবং ৩রা এপ্রিল ২০১১ তারিখ সকালে সমুদ্রের ১৩০০০ ফুট নীচে ফ্লাইট ৪৪৭ এর ধংসাবশেষ অবিষ্কার করে। পানির নীচে তোলা ডিজিটাল আলোকচিত্রে দেখা যায় বিমানটি ৬০০ থেকে ২০০০ ফুট জায়গা জুড়ে রয়েছে। এ থেকে ধারনা করা হয় সমূদ্রে তলিয়ে যাওয়ার সময় বিমানটি একেবারে ভেঙ্গে চূর্ন বিচূর্ন হয়ে যায় নি। সুতরাং বোমা বিষ্ফোরন অথবা ঝড়ের কারনে যে বিমানটি ধংস হয় নি এ বিষয়টি ষ্পষ্ট হয়। ফ্রান্স সরকার যুক্তরাষ্ট্রের ফিনিক্স ইন্টারন্যাশনাল নামক সংস্থাটিকে উদ্ধারকর্ম পরিচালনার দায়ীত্ব দেয়। সমূদ্রের নীচ থেকে উদ্ধারকর্ম পরিচালনার ক্ষেত্রে ফিনিক্স অত্যন্ত পারদর্শী এবং এই প্রতিষ্ঠানটিই সমূদ্রের নীচ থেকে টাইটানিক জাহাজ উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করেছিল। ২৬শে এপ্রিল ২০১১ তারিখে ফিনিক্সের কর্মীরা ফ্লাইট ৪৪৭ এর ককপিট ভয়েস রেকর্ডার ও ফ্লাইট ড্যাটা রেকর্ডার উদ্ধার করে প্যারিস প্রেরন করে। একই সাথে বিমানের ধংসাবশেষে থাকা নিহত যাত্রীদের মরদেহও উদ্ধার করা হয়। ফ্লাইট ৪৪৭ এর ২২৮ জন যাত্রী ও ক্রুদের মধ্যে মোট ১০৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়।

বিইএ’র বিশ্লেষকরা ১৬ই মে ২০১১ তারিখের মধ্যে সিভিআর ও এফডিআর ড্যাটা পরীক্ষা শুরু করেন এবং  ২০শে মে’র মধ্যে ফ্লাইট ৪৭৭ এর দূর্ঘটনার রহস্য ভেদ করা সম্ভব হয়। ২৭শে মে ২০১১ তারিখে ফ্রান্সের তদন্ত ও বিশ্লেষন ব্যুরো (বিইএ) এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইট এএফ ৪৪৭ এর দূর্ঘটনার পূর্নাঙ্গ প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন সরকারীভাবে প্রকাশ করে।

কি ঘটেছিল ফ্লাইট এএফ ৪৪৭ এ?

ক্যাপ্টেন মার্ক দ্যুবোয়া’র কমান্ডে ফ্লাইট ৪৪৭ ব্রাজিল সময় সন্ধ্যা ৭:২৯ এ রানওয়ে ত্যাগ করে আকাশে উঠে আসে। এ সময় বিমানের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে ডান দিকের আসনে বসে ছিলেন ফার্ষ্ট অফিসার পিয়েরে সেড্রিক বুনাঁ। ফার্ষ্ট অফিসার ডেভিট রবার্ট বা ডেভ রব্যা ক্রুদের বিশ্রামস্থলে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। ক্যাপ্টেন মার্ক দ্যুবোয়া  এয়ার ফ্রান্সের একজন অতি মুল্যবান পাইলটদের একজন ছিলেন। তাঁর জীবনের অর্ধেক সময় ধরেই তিনি বিমান চালিয়েছেন। ফার্ষ্ট অফিসার পিয়েরে সেড্রিক বুনাঁও একজন অভিজ্ঞ পাইলট ছিলেন। এয়ারবাস এ ৩৩০ চালানোর ক্ষেত্রে তাঁর এক বৎসরের অভিজ্ঞতা ছিল। ফার্ষ্ট অফিসার ডেভ রব্যা এক বছরের কিছু বেশী সময় ধরে এয়ারবাস এ ৩৩০ পরিচালনা করেছেন। ইউটিসি সময় ভোর ১:৪৮ মিনিটে ব্রাজিলিয়ান এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল ফ্লাইট ৪৪৭ কে আটলান্টিক সেন্টারের সাথে যোগাযোগের নির্দেশ দেয়। দক্ষিন আটলান্টিক মহাসাগরের উপর দিয়ে চলাচলকারী সব ধরনের বাণিজ্যিক বিমান সমূহকে সমূদ্রের উপরে আকাশপথে প্রবেশের আগে আটলান্টিক সেন্টারের সাথে যোগাযোগ করতে হয় কারন পরবর্তী এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের হাতে সমর্পন করার পূর্ব পর্যন্ত বিমানটি নিয়ন্ত্রন করে আটলান্টিক সেন্টার। ক্যাপ্টেন মার্ক দ্যুবোয়া আটলান্টিক সেন্টারের সাথে যোগাযোগ করে তাঁর অবস্থান জানান। এই সময় তিনি ব্রাজিল আকাশ সীমার সর্বশেষ ওয়েপয়েন্ট ইন্টল অতিক্রম করছিলেন। আটলান্টিক সেন্টার বিমানের উর্ধসীমা ৩৫০০০ ফিট নির্ধারন করে তাঁকে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। ভোর ২:১০ মিনিটে ফ্লাইট ৪৪৭ মধ্য আটলান্টিকের কমিউনিকেশন ডেড জোনে প্রবেশ করলে  বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ সম্পূর্নরুপে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

বিশ্রাম শেষে ফার্ষ্ট অফিসার ডেভিট রবার্ট বা ডেভ রব্যা ককপিটে এলে ক্যাপ্টেন মার্ক দ্যুবোয়া বিশ্রামে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ক্যাপ্টেন দ্যুবোয়া খুবই ক্লান্ত ছিলেন কারন সন্ধ্যায় ফ্লাইট ৪৪৭ এ উঠার আগে তিনি মাত্র এক ঘন্টা ঘুমুতে পেরেছিলেন। ক্যাপ্টেন মার্ক দ্যুবোয়া বিশ্রামে যাওয়ার পর ক্যাপ্টেনের সীটে ডেভ রব্যা বসলেও বিমানের নিয়ন্ত্রন থাকে অটো পাইলটের হাতে এবং সার্বক্ষনিক মনিটরিং এবং তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষমতা থাকে ফার্ষ্ট অফিসার বুনাঁর হাতে। এ সময় বিমানটি মধ্য আটলান্টিক মহাসাগরের সবচাইতে ঝন্জাবহুল অন্চল অতিক্রম করছিল। এটি এমন একটি অন্চল যেখানে পৃথিবীর দু’প্রান্ত থেকে প্রবাহিত বাণিজ্য বায়ু মিলিত হয়ে সবচাইতে ভয়ংকর বৈদ্যুতিক ঝড়ের সৃষ্টি করে। এই ভয়ংকর এলাকার আকাশে ক্রমাগত মেঘ তৈরী হতে থাকে এবং ঘন্টায় তিন শ কিলোমিটারেরও অধিক বেগে ঘূর্ণীবায়ূ বয়ে যেতে থাকে। ঘন্টায় ৩১০ মাইল বেগে চলতে চলতে বিমানটি হঠাৎ করেই বরফ ক্রিষ্টাল বোঝাই মেঘের ভেতর প্রবেশ করলে কিছু বরফ গতিবেগ নির্ণয়কারী পিটোটিউবের ভেতর ঢুকে পরায় বাতাসের প্রবাহ বিঘ্নিত হয়ে গতিবেগ প্রদর্শনকারী মনিটর ত্রুটিপূর্ন রিডিং দিতে থাকে। বিমানের অটোপাইলট প্রকৃত গতিবেগ বুঝতে না পেরে একেবারে হঠাৎ করেই বিমানের নিয়ন্ত্রন ছেড়ে দেয়। এয়ারবাস কোম্পানী অনেক আগেই এ ৩৩০ এবং এ ৩৪০ বিমানের পিটোটিউব সমস্যার কথা বিমান সংস্থা সমূহকে জানিয়েছিল এবং পাইলটদের এ বিষয়ে করনীয় সম্পর্কে প্রশিক্ষনও প্রদান করা হয়েছিল। পিটোটিউবে বরফ জমে যে সমস্যা সৃষ্টি হয় তার মেয়াদ হচ্ছে ছাপ্পান্ন সেকেন্ড। এর মধ্যেই পিটোটিউব স্বয়ংক্রিয়ভাবে বরফ গলিয়ে কাজ শুরু করে এবংঅটোপাইলট পুনরায় নিজে থেকে নিয়ন্ত্রন গ্রহন করে। নিয়ম হচ্ছে এই ছাপ্পান্ন  সেকেন্ড যে কোন একজন পাইলট বিমানের নিয়ন্ত্রন গ্রহন করে অটোপাইলট পুনরায় নিয়ন্ত্রন গ্রহন করা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। এ সময় পাইলট বিমানের গতি কিংবা দিক ইত্যাদির কোন ধরনের পরিবর্তন করবে না। কিন্তু, ফ্লাইট ৪৪৭ এর অটোপাইলট নিয়ন্ত্রন ছেড়ে দেয়ার সাথে সাথে ফার্ষ্ট অফিসার বুনাঁ কোন অজানা কারনে  বিমানের নাক উপর দিকে তুলে দেয়। যেহেতু ৩৫ হাজার ফিট উপরে বাতাস অত্যন্ত পাতলা, নাক উপরের দিকে তুলে দেয়ায় বিমানের ডানার নীচ থেকে বাতাস সরে গেলে বিমানের গতিবেগ হ্রাস পায়। বিমানটির গতিবেগ ৩১০ নটিক্যাল মাইল থেকে কমে ২২০ এ চলে আসে ফলে একটি অ্যারোডাইনামিক ষ্টল অবস্থার সৃষ্টি হয় এবং বিমানটি  পরে যেতে থাকে। এ ধরনের অবস্থায় নিয়ম হচ্ছে বিমানের নাকটি নীচু করা যাতে ভেসে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় গতি অর্জন করা যায়। কিন্তু, যথেষ্ট প্রশিক্ষন ও অভিজ্ঞতা থাকা সত্বেও ফার্ষ্ট অফিসার বুনাঁ আরও বেশী করে বিমানটির নাক উপর তুলতে থাকেন ফলে বিমানটি খুব দ্রুত উচ্চতা হাড়ায়। এ পর্যায়ে বিমানটি প্রতি মিনিটে ১২০০০ ফিট উচ্চতা হাড়াতে থাকে। ফার্ষ্ট অফিসার রব্যা বিষয়টি লক্ষ্য করে বিমানের নিয়ন্ত্রন নিজের হাতে নিয়ে নাক নীচু করার চেষ্টা করতে থাকেন কিন্তু একই সাথে ফার্ষ্ট অফিসার বুনাঁ তাঁর ষ্টিয়ারিং ষ্টিকটি ব্যবহার করে বিমানের নাক উচু করার চেষ্টা করতে থাকেন। ফলে বিমান উচ্চতা হাড়িয়ে ২২০ মাইল গতিতে সমূদ্রের বুকে সরাসরি নেমে আসে এবং ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে ১২০০০-১৩০০০ ফিট পানির নীচে তলিয়ে যায়। একেবারে শেষ মুহুর্তে ক্যাপ্টেন দ্যুবোয়া ককপিটে এলেও তাঁর করার কিছু ছিল না। বিমান সমূদ্রে আছড়ে পরার সময় সব যাত্রী ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলেন ফলে তাদের অজান্তেই মৃত্যু এসেছে হঠাৎ করে।

২০১২ সনের ৫ই জুলাই ফ্রান্সের তদন্ত ও বিশ্লেষন ব্যুরো (বিইএ) এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইট ৪৪৭ দূর্ঘটনার বিষয়ে চুড়ান্ত রিপোর্ট প্রকাশ করে। এতে বিমান দুর্ঘটনা ও যাত্রী এবং ক্রুদের মৃত্যুর জন্য বিমানটির পাইলটদের অদক্ষতা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহনে অপারগতাকে দায়ী করা হয়।

 দূর্ঘটনার ঠিক পরপরেই এয়ার ফ্রান্স তার রিও ডি জেনিরো-প্যারিস ফ্লাইটের কোড এএফ ৪৪৭ থেকে এএফ ৪৪৫ এ পরিবর্তন করে।


মে ডে: পরবর্তী পর্ব- জার্মানীর আকাশে সংঘর্ষ: ঝরে পরলো ৪৮টি উদীয়মান উজ্জল নক্ষত্র
 

No comments:

Post a Comment